রবিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

সেই ত্রিশ সেট অলঙ্কারসহ নায়িকারা নির্বাসিত

পীর হাবিবুর রহমান

সেই ত্রিশ সেট অলঙ্কারসহ নায়িকারা নির্বাসিত

সেনাশাসক এরশাদের জমানায় সংরক্ষিত মহিলা আসনের জাতীয় পার্টির ৩০ জন সংসদ সদস্যকে গণমাধ্যমে ৩০ সেট অলঙ্কার বলা হয়েছিল। সেনাশাসকরা ক্ষমতা দখল করে সুবিধাভোগী শ্রেণি-পেশার মানুষ ও দলছুট রাজনীতিবিদদের নিয়ে দল করতেন। সেখানে সংসদে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান থেকে সেনাশাসক এরশাদ পর্যন্ত সংরক্ষিত মহিলা আসনে সুবিধাভোগী অভিজাত রমণীদের সংসদ সদস্য করেছেন, দলে টেনেছেন। যোগ্যতা, মেধা ও সামাজিক প্রভাবের ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে থাকলেও রাজনৈতিক কমিটমেন্টের ক্ষেত্রে ততটাই পিছিয়ে ছিলেন। সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের মহিলা এমপিরা পরবর্তীতে দল ক্ষমতাচ্যুত হলে অনেকে সরে পড়লেও কেউ কেউ দলে ভূমিকা রেখেছেন। সেনাশাসক এরশাদের পতনের পর যারা আর সংরক্ষিত আসনে মহিলা এমপি হতে পারেননি তারা আর দলের ধারেকাছে আসেননি। তারা এখন কে কোথায় আছেন কেউ জানে না।

সেই ৩০ সেট অলঙ্কার এখন নির্বাসিত। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি থেকেও দলের পোড় খাওয়া মাঠকর্মীরা মহিলা এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দলই নয়, ঐতিহাসিক এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে এ দলটি নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধাীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম সংসদেও বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ করে উঠে আসা রাফিয়া আকতার ডলি থেকে অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান-পত্নী মমতাজ বেগমসহ আওয়ামী লীগ পরিবারের পরীক্ষিত নারীদের সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করেছেন। তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মেধা ও কমিটমেন্ট উঁচুস্তরেই ছিল।

সংবিধান সংশোধনের ধারাবাহিকতায় মহিলাদের জন্য সংসদের সংরক্ষিত আসনসংখ্যা এখন সেই ১৫ থেকে ৫০-এ এসে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি দল থেকে নির্বাচনে বিজয়ী প্রতিটি দলের ছয় জনে একজন সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি পান। এতে আওয়ামী লীগ ৪৩টি আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের সুযোগ পেয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি পেয়েছে চারটি আসন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যোগ দিলে পাবে একটি আসন। বাকিরা পাবেন দুটি আসন। আওয়ামী লীগ ৪১ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। ১৫ শতাধিক আবেদনকারীর মধ্যে ছাত্রলীগ করে উঠে আসা দলের যোগ্য ত্যাগী ও মেধাবী প্রার্থীর সংখ্যাই ছিল অনেক। মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ ও আওয়ামী লীগে সক্রিয় নারী নেত্রী ছাড়াও আওয়ামী লীগ পরিবারের অনেক নারী মনোনয়ন চেয়েছিলেন।

মৌমাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে নাটক ও সিনেমাপাড়ার নায়িকা-গায়িকা নেমেছিলেন যেমন তেমনি হঠাৎ আওয়ামী লীগ হওয়া সুবিধাবাদীরা তো ছিলেনই। ‘৯৬ সালেও শেখ হাসিনা দলের ত্যাগী নেত্রীদের মনোনয়ন দিতে ভুল করেননি। এবার প্রথম দিনের বৈঠকেই ৪৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৪১টি চূড়ান্ত করে তালিকা প্রকাশ করেছে। এত বিশাল দল এত কর্মী সেখানে ৪৩ জন বাছাই করা কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটিই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্লামেন্টারি বোর্ড চূড়ান্ত করেছে। মূলত শেখ হাসিনা দীর্ঘ সময় নিয়েই তালিকা করে মনোনয়ন বোর্ডে আলোচনা করে অনুমোদন নেন। দেশের শিল্পীদের মধ্য থেকে এবার একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রথিতযশা অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে এমপি করা হচ্ছে। অভিনেতা ও আবৃত্তিকার মরহুম গোলাম মুস্তাফার কন্যা সুবর্ণা এ দেশের থিয়েটার ও নাটকে মঞ্চ থেকে টিভি পর্দায় জনপ্রিয় করতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন। চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। একজন শিল্পীকে এবার এমপি করা নতুন নয়, অতীতেও আওয়ামী লীগ কবি, শিল্পী ও সাংবাদিকদের সংরক্ষিত মহিলা কোটায় মনোনয়ন দিয়েছে।

যত দূর খোঁজ নিয়ে জেনেছি, যারা মহিলা এমপি হতে যাচ্ছেন তারা দলের প্রতি কমিটেড ও মাঠের পোড় খাওয়া কর্মী। তারা অভিজাত হতে না পারেন কিন্তু দলের দুঃসময়ে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন। শেখ হাসিনা তার মাঠের কর্মীদের মূল্যায়ন করেছেন। বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারীর ক্ষমতায়নের এই যুগে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে নিরন্তর ভূমিকা রাখা আরও উচ্চশিক্ষিত মেধাবী সৃজনশীল দক্ষ নেতৃত্ব যারা সমাজে আলোকিত হয়ে ভূমিকা রাখছেন তাদের কাউকে কাউকে যুক্ত করলে সংসদ প্রাণবন্ত হতো। তবু একটি বিশাল দলের জন্য বিশাল নারী কর্মীর মধ্য থেকে ৪৩ জন চূড়ান্ত করা অনেক কঠিন কাজ। অতীতে যাদের সংসদে আনা হয়েছিল যোগ্যতায় এগিয়ে থাকলেও এবার তাদের প্রায় সবাই, দুজন ছাড়া বাকিরা বাদ পড়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, মহিলা এমপির মনোনয়ন যারা পেয়েছেন তারা আর কিছু করার যোগ্যতা রাখেন না তালিকায় তাদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু কেউ অস্বীকার করছেন না যারা তালিকায় জায়গা পেয়েছেন তারা আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী নন।

হয়তো যারা অনেক বেশি যোগ্যতা থাকার পরও, দলের প্রতি নিবেদিত থাকার পরও, এখনো এমপি হতে পারেননি বা ক্ষমতাসীন দলের মূল্যায়নের খাতায় নাম ওঠেনি তারা নিশ্চয়ই সামনে মূল্যায়িত হবেন। প্রাপ্য মর্যাদা পাবেন দল থেকে।

যাদের ওপর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নির্ভর করে, বিশ্বাস করে, আস্থা নিয়ে মর্যাদা রেখেছেন তাদের এখন নিজেদের সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে ভূমিকা রাখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার কঠিন চ্যালেঞ্জ এখন তাদের। সুবর্ণা মুস্তাফাই নন, পাকিস্তান গণপরিষদে যিনি প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলেন একাত্তরের সেই শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি মানবাধিকার নেত্রী আরমা দত্তকেও মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, এটা অভিনন্দনযোগ্য।

খুলনা থেকে শিরিন নাহার লিপিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ বিতর্ক তুলেছেন এই বলে যে, তিনি বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজলের স্ত্রী। কিন্তু লিপি যেখানে আওয়ামী লীগ নেতার কন্যা ও ছাত্রলীগ থেকে এখন পর্যন্ত যুব মহিলা লীগ হয়ে দলের প্রতি নিবেদিত সেখানে বৈবাহিক সম্পর্ক তার রাজনীতির প্রাপ্তিতে কোনো বাধা হতে পারে না। মৌমাছির মতো আসা যে নায়িকারা মনোনয়ন লড়াইয়ে পরাজিত হয়েছেন তাদের বেদনা পাওয়ার কিছু নেই। সিনেমা-নাটকের বিচ্ছেদের দৃশ্যের মতো অশ্রু ফেলার কিছু নেই। আওয়ামী লীগকে ভালোবাসলে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করলে, দলে যখন এসেছেন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করুন। সুদিনে দুর্দিনে দলের জন্য কাজ করে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হোন। এই দল করে অনেকে জীবন শেষ করেছেন। এমপি-মন্ত্রী-নেতা হননি। জেল-জুলুম, মামলা, রিমান্ড, পুলিশি নির্যাতন, এমনকি নির্বাসিত জীবনের যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। এটাকেই বলে আত্মত্যাগ। আবার অনেকেই একেবারেই নেতা-এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। এটাকে বলে ভাগ্য। ভাগ্যের ওপর রাজনীতি হয় না। রাজনীতি মানবকল্যাণে আদর্শের ওপরে বিশ্বাস নিয়ে করতে হয়; যেখানে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব থাকে না। বেশির ভাগ তা-ই করছেন।

আমরা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছি- দেশ নারীর ক্ষমতায়নে এগিয়েছে। উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে শেখ হাসিনার হাত ধরে। নারীরা অনেক অগ্রসর। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জেলা পরিষদ, উপজেলা পর্যন্ত সরাসরি ভোটযুদ্ধ করে বিজয়ী হচ্ছেন। অনেকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ নির্বাচনেও লড়ছেন। কেউ বিজয়ী হচ্ছেন, কেউ পরাজিত হচ্ছেন। নারীকে দাবিয়ে রাখার বা সমাজের অনগ্রসর অংশ বলার দিন শেষ। এ অবস্থায় সংসদের সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ আরও ২৫ বছর বাড়ানো কতটা যৌক্তিক- আইনপ্রণেতাসহ রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে ভাবতে হবে। সংরক্ষিত আসন তুলে দিয়ে নারীদের দলীয়ভাবে মনোনয়নদানের সুযোগ বাড়িয়ে সরাসরি ভোটযুদ্ধ করে সম্মানজনকভাবে বিজয়ী হয়ে সংসদে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। সময় এখন এ কথায় বলছে। এর জন্য সংরক্ষিত আসন তুলে দিয়ে নির্বাচনে প্রতি দলে আনুপাতিক হারে মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।

সর্বশেষ খবর