সোমবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার

বঙ্গবন্ধুর পতনের জন্য জাসদকে দায়ী করে লাভ নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গবন্ধুর পতনের জন্য জাসদকে দায়ী করে লাভ নেই

হাসানুল হক ইনু

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ একাংশের সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর পতনের জন্য জাসদকে দায়ী করে লাভ নেই। ১৫ আগস্টের পর জাসদের কেউ মন্ত্রী হননি। তিনি বলেন, ’৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসন থেকে বের করে আনার জন্য জাসদের আপসহীন সংগ্রাম ইতিহাসে স্বর্ণ অক্ষরে লেখা আছে।

গত শনিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। তার দীর্র্ঘ সাক্ষাৎকারের একাংশ আজ প্রকাশ করা হলো।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের অন্যতম শরিক হাসানুল হক ইনু বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পেছনে যারা জাসদকে দায়ী করেন, তারা ভুলে যান ’৭২-৭৫ পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী ছিল। তখন জাসদ একমাত্র বিরোধী দল ছিল না। বঙ্গবন্ধু যখন সংসদীয় গণতন্ত্রে পা রাখলেন, সংবিধান দিলেন, ’৭৩ সালে নির্বাচন দিলেন, সেই নির্বাচনে জাসদ ২৩৬টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। মোজাফ্ফর ন্যাপ, ভাসানী ন্যাপসহ কতিপয় রাজনৈতিক দল সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অত্যন্ত পরিচিত ও জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তারা সবাই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধী ছিলেন। তখন শীতল যুদ্ধ চলছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে। আমেরিকা, পাকিস্তান, চীন বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ছিল। তারা একাত্তরের পরাজয় মেনে নেয়নি এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে উসকানি দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু দয়াপরবশ হয়ে পাকিস্তানে আটকে থাকা সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি অফিসার-কর্মচারীদের প্রশাসনে চাকরি দেন। তখন প্রশাসন বিভক্ত হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকে একটি দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করতে হয়। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। শুধু জাসদকে আলাদা করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার জন্য যারা অভিযোগ উত্থাপন করছেন, তারা কার্যত, যে কারণে তিনি মারা গেছেন, যে কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, সেসব আসল খুনি এবং রাজনৈতিক ফ্যাক্টরগুলো আড়াল করছেন। আমাদের কারণেই যদি তার পতন হয়ে থাকে, আমরা যদি বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী হয়ে থাকি, তাহলে ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এবং খুনি মোশতাকের বিরুদ্ধে আমরা মিছিল করে প্রতিবাদ করতাম না।

হাসানুল হক ইনু বলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। তখন জাসদের কোনো নেতা মুক্তি পাননি। বরং খন্দকার মোশতাকের ৮৩ দিনের শাসনকালে শতাধিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়। সে সময় আমরা খন্দকার মোশতাকের স্টিমরোলারের নিচে পড়েছিলাম। তিনি বলেন, পার্লামেন্ট বাতিল না করে খন্দকার মোশতাক একটা রাজনৈতিক ভুল করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা তখনো বহাল ছিলেন। কিন্তু কোনো সংসদ সদস্য প্রেস ক্লাবে গিয়েও প্রতিবাদ করেননি। সুতরাং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সীমাহীন ব্যর্থতা, কাপুরুষতা ঢাকার জন্য বঙ্গবন্ধুর পতনে জাসদকে দায়ী করে লাভ নেই। জাসদ-আওয়ামী লীগের এই বিভেদটা যারা জিইয়ে রাখতে চায়, তারা কার্যত বাংলাদেশে রাজাকারদের রাজনীতি করাতে চায়। ইনু বলেন, শেখ হাসিনার দূরদর্শী রাজনীতির কারণে জাসদকে তিনি টেনে নেন। আমরাও বাংলাদেশকে রাজাকারমুক্ত করার জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাত মিলিয়েছি। আমি ইনু জাসদের এ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের বিরোধিতার মুখে পড়েছি। আ স ম আবদুর রবসহ অনেক নেতাই জাসদের বাইরে আছেন। তারা আওয়ামী লীগ ও জাসদের ঐক্য চান না। যারা সম্প্রতি জাসদ থেকে বেরিয়ে গেছেন, তারাও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কলঙ্কিত নির্বাচন বলেছেন। সুতরাং আওয়ামী লীগ-জাসদের ঐক্য রক্ষা করতে গিয়ে আমি দলের শীর্ষ নেতাদের হারিয়েছি। শেখ হাসিনাও তার দলের ভিতরে অনেক সমালোচনার মুখে পড়ছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা জানেন, জাসদ একটি রাজনৈতিক দল। জাসদ গোপনে কিছু করেনি। রাজনৈতিক কারণেই আমরা বিরোধিতা করেছি। যারা আওয়ামী লীগ-জাসদ বিভেদ দেখতে চায়, তারা প্রকৃতপক্ষে বিএনপি-জামায়াতকে প্রশ্রয় দিতে চায়। আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ষাটের দশকে একসঙ্গে রাজনীতি করেছি। রাজনৈতিক কারণেই তাঁর বিরোধিতা করেছি। কিন্তু কোনো দিনই বঙ্গবন্ধুর শারীরিক হত্যার স্বপ্নও দেখিনি, পরিকল্পনাও করিনি। যে কারণে জাসদের নেতৃবৃন্দ গোপনে বসে এই ঘোষণা দেয়, বঙ্গবন্ধুর বিকল্প খুনি মোশতাক ও সামরিক স্বৈরাচার জিয়া হতে পারে না। সুতরাং আজকে আবারও বলব, আওয়ামী লীগ-জাসদের ঐতিহাসিক ঐক্য রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশকে রাজাকারমুক্ত করতে হবে। যুদ্ধাপরাধী ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করতে হবে।

’৭৫-পরবর্তী ট্যাঙ্কের ওপর নাচানাচির একটি ছবি সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসানুল হক ইনু বলেন, ২০১৩ সালে জামায়াতের ফেসবুকে এই ছবি দেখা যায়। ১৫ আগস্টের হত্যাকাে র পর ১৬-১৭ তারিখ কোনো জায়গায় উল্লাস প্রকাশ হয়নি। সে সময়ের পত্রিকা দেখেন, কোথাও জনগণের উল্লাসের প্রকাশ নেই। ট্যাঙ্কের ওপর নাচানাচির যে ছবি তা হাসানুল হক ইনুর না। সেই ছবি একজন প্যান্টপরা গোঁফওয়ালা ব্যক্তির ছবি। এটা সম্ভবত, ৭ নভেম্বরের পর। তখন আর্মির সঙ্গে ট্যাঙ্কের ওপর নাচানাচির অনেক ঘটনা আছে। ১৫ আগস্টের পর কোনো মানুষ রাস্তায় টুঁ শব্দ করেনি। আর্মিও রাস্তায় বের হয়নি। তারা শুধু বেতার ভবনে ছিল, বঙ্গভবনে ছিল, টেলিভিশনে ছিল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিল। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে যখন জাসদ শুরু করি, তখন থেকে আমি পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ছাড়া জনসম্মুখে যাইনি।

সর্বশেষ খবর