সোমবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

আত্মসমর্পণ না আটক?

স্বজনরা লাঞ্ছিত, এলাকায় স্বস্তি

নিজামুল হক বিপুল ও আয়ুবুল ইসলাম

আত্মসমর্পণকারী ১০২ জন ইয়াবা কারবারি পুলিশের হেফাজতে ছিল না- এমন তথ্যই দিয়েছে পুলিশ। বরং পুলিশ বলছে, শতাধিক ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে গত শনিবার ভোর রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বিচ হ্যাচারি এলাকায় জড়ো হয়েছিল। এ খবর পেয়ে টেকনাফ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এবিএমএস দোহার নেতৃত্বে ওই এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশের একটি দল। পুলিশ সদস্যদের দেখে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা অস্ত্র ও ইয়াবা ফেলে আত্মসমর্পণ করে। সেখান থেকে ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা ও ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্র। টেকনাফ মডেল থানায় যে মামলা দায়ের করা হয়েছে তাতে এ কথাগুলোই উল্লেখ করেছেন মামলার বাদী টেকনাফ থানার পরিদর্শক অপারেশন শরীফ ইবনে আলম। আর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে থানার অপর পরিদর্শক (তদন্ত) এবিএমএস দোহাকে। টেকনাফ পুলিশের এক কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অথচ, এই ইয়াবা কারবারিরা আত্মসমর্পণের জন্য গত জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই কক্সবাজার পুলিশ লাইনসে জড়ো তাকেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদনও হয়েছে। কিন্তু পুলিশের দায়ের করা মামলার এজাহারে এ প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্যই পুলিশ কখনই স্বীকার করেনি যে আত্মসমর্পণ করার জন্য ইয়াবা কারবারিরা তাদের হেফাজতে আছেন। কিন্তু আত্মসমর্পণকারীদের স্বজনরা কক্সবাজার পুলিশ লাইনসে নিয়মিত তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। খাবার দিয়েছেন। এটা বিভিন্ন সময়ে স্বজনরা সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে (নং-২৬ ও ২৭)। এই দুুটি মামলায় টেকনাফের সরকারদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই আবদুস শুক্কুরকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। তার অপর তিন ভাই আমিনুর রহমান, শফিকুল ইসলাম ও ফায়সাল রহমানকেও এই মামলায় আসামি করা হয়েছে (২, ৮ ও ৯ নম্বর আসামি)। এ ছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ছেলে দিদার মিয়াকে ৪ নম্বর এবং জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে লেদার নুরুল হুদাকে ৩ নম্বর ও এনামুল হককে ১০ নম্বর আসামি করা হয়েছে। শাহেদুর রহমান নীপুকে ৫ নম্বর ও ডেইল পাড়ার নুরুল আমিনকে ৬ নম্বর আসামি করা হয়েছে। এদিকে গত শনিবার দুপুরে আত্মসমর্পণের পর ১০২ ইয়াবা কারবারিকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। আদালত সূত্রে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত আত্মসমর্পণকারীদের পক্ষে কেউ জামিনের আবেদন করেননি। অপরদিকে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা টেকনাফ থানার পরিদর্শক এবিএমএস দোহা জানান, অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা দায়ের হলেও এটি একটি ব্যতিক্রমী মামলা। কাজেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী মামলার তদন্ত সম্পন্ন করা হবে।

স্বজনরা যা বলেন : ‘তখন সবাই ইয়াবা ব্যবসা করত, পাড়ায় খুব কম পরিবার ছিল যারা ইয়াবা ট্যাবলেটের ব্যবসা করত না। সবাই রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার মতো অবস্থা। নিজেদের গরিব অবস্থা দেখে আমার ভাইও এক সময় এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে টাকার লোভে। অনেক টাকা আয় করেছে, শুধু আমার ভাই নয়, পাড়া পড়শি সবাই টাকা কামাইছে। কেউ কাউকে বাধা দেয়নি, তাই আমরাও ভাইকে বাধা দিইনি। বাধা কেন দেব, পাড়ার সব ভালো মানুষ এ কাজ করেছেন। কেউ বলত না যে এটি অপরাধ।’ একনাগারে এই কথাগুলো বলেন আত্মসমর্পণ করা ইয়াবা কারবারি সাবরাং ঝিনা পাড়ার আলী আহমদের বোন রুবিনা বেগম।

তিনি বলেন, ‘সে সময় আমরা বুঝিনি ইয়াবা ব্যবসায় একটি ঘৃণিত কাজ। মন্ত্রী সাহেবের এবং পুলিশ প্রধানের কথায় আমাদের ঘুম ভেঙেছে। আজ বুঝতে পেরেছি আমরা পরোক্ষভাবে ইয়াবা ব্যবসায়ে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা দিয়ে মারাত্মক ভুল করেছি। ভবিষ্যতে পরিবারের আর কোনো সদস্যকে ইয়াবার মতো এই ঘৃণিত কাজে জড়াতে দেব না। আত্মসমর্পণকারী টেকনাফ পৌরসভার নাইট্যংপাড়ার নুর হাবিবের মা জিন্নাত বেগম বলেন, ‘এত মানুষের সামনে ছেলে ইয়াবা কারবারি হিসেবে আত্মসমর্পণ করছে, মা হিসেবে আমার খুব লজ্জা লাগছে। তবে একটু স্বস্তি পাচ্ছি যে, ছেলে এখন থেকে আর ইয়াবা ব্যবসা করবে না।’

টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাতিয়ার ঘোনার বাসিন্দা ইয়াবা কারবারি মো. হাসানকে দেখতে এসেছিলেন তার স্ত্রী লতিফা বেগম। তিনি বলেন, ‘এক সময় সবার দেখাদেখি আমার স্বামীও ইয়াবা কারবারে জড়িয়েছিলেন। আমাদের ভয় ছিল ইয়াবা কারবারি স্বামীর কখন কী হয়ে যায়। তবে সরকার তাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ইয়াবার পথ থেকে ফিরতে যে সুযোগ দিয়েছে তাতে আমরা খুশি।’

স্কুলশিক্ষক ও টেকনাফ উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাস্টার জাহেদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের জন্য একটু স্বস্তি পাওয়ার দিন। ভবিষ্যতে ইয়াবা বন্ধ হোক বা না হোক, এত বড় সমাবেশে হাজার হাজার মানুষ যে ইয়াবার বিরুদ্ধে জেগেছে সেটাই দেখার বিষয়। এখন আমাদের সবার দায়িত্ব হচ্ছে, ইয়াবার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে জনতার এই চেতনা জাগিয়ে রাখা।’ ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘এরপরও যদি টেকনাফের কোনো মানুষ ইয়াবার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে তাহলে এরচেয়ে দুঃখজনক কিছু থাকবে না। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান আমাদের জন্য একদিকে পাপ মোচনের, অন্যদিকে লজ্জার।’

টেকনাফ ডিগ্রি কলেজের ¯œাতক ২য় বর্ষের ছাত্রী রহিমা আকতার বলেন, ‘আমাদের সমাজে মাদক কারবারিরা এতদিন বীরদর্পে ঘুরাফেরা করত। ইয়াবার মতো ঘৃণিত অপরাধে সম্পৃক্ত থাকা সত্ত্বেও তাদের কোথাও কোনো বাধা ছিল না। অর্থ সম্পদের প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে তাদের সামাজিক মর্যাদাও ছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছে আজ থেকে টেকনাফের মানুষ ইয়াবা কারবারিদের ঘৃণা করতে শিখেছে।’ প্রসঙ্গত, শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ১৪ স্বজন, ৮ জনপ্রতিনিধিসহ ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেছেন। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে আত্মসমর্পণকারীদের বেশ বিব্রতকর অবস্থায় দেখা যায়। অনেকে লজ্জায় মুখে কাপড় বেঁধে পরিচয় লুকানোর চেষ্টা করেছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর