মঙ্গলবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ক্ষমতার হিসাব ভোটের জোটে

রফিকুল ইসলাম রনি

ক্ষমতার হিসাব ভোটের জোটে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয় পায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। কিন্তু মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয়নি জোট শরিকদের। মন্ত্রিসভা গঠনের আগে জোট শরিকদের সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা রাখতে প্রস্তাব দেওয়া হয়। সবকিছু মিলিয়ে শরিক দলের নেতা-কর্মীরা ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ ও নাখোশ। জোটের নেতাদের বক্তব্যেও সেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ১৪ দলের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়েও পরিষ্কার কোনো নির্দেশনা নেই। বিষয়গুলো নিয়ে শরিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। এখন চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাচ্ছে ভোটের জোটে। জোটের শরিক দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, আমরা নৌকার কথা বলে, শেখ হাসিনার উন্নয়নের কথা বলে ভোট নিয়েছি। এখন বিরোধী দলে গিয়ে সরকারের বিরোধিতা করলে আগামীতে আমাদের রাজনীতি হুমকির মুখে পড়বে। অন্যদিকে উপজেলা নির্বাচনেও এককভাবে অংশগ্রহণ করায় জোটের রাজনীতিতে ভাটা পড়ছে। কেন্দ্রীয়ভাবে জোট চর্চা বা শরিকদের মূল্যায়ন হলেও তৃণমূলে একেবারেই কম। সে কারণে জোটের ভবিষ্যৎ কী সে বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন ‘একলা চলো নীতি’তে হাঁটছে। তারা আরও বলছেন, ২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪-দলীয় জোট গঠন করা হয়েছিল। এর অনেক দফা বাস্তবায়ন হয়েছে। এখনো অনেক কাজ বাকি। সে কারণে জোটের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের ‘একলা চলো নীতি’ পরিহার করতে হবে। এরই মধ্যে শরিকদের সরকার চাপ দিচ্ছে, সংসদে যেন তারা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। তবে এটা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেন শরিক দলের একাধিক নেতা। তারা বলেন, কে সরকারি দলে থাকবে, কে বিরোধী দলে থাকবে তা ওই দলকেই নির্ধারণ করতে হবে। কার্যত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১৪-দলীয় জোটে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে শরিকদের মন্ত্রিসভায় না রাখার ফলে অসন্তোষ বাড়ছে।  এ প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৪-দলীয় জোট হয়েছে একটি আদর্শের ভিত্তিতে। জোটগতভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হলেও কেবল আওয়ামী লীগের সদস্যদের দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে।’ গত বুধবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে ১৪ দলের শরিকদের নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে ১৪ দলের ভূমিকা কী হবে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তারা শুনতে চান এবং খুব শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করার জন্য বলেন। বৈঠকে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ১৪ দলই যদি থাকে তাহলে তো আমাদের সংসদে সরকারি দলের বেঞ্চে বসার কথা। আর বিরোধী দলে বসতে হলে ১৪ দলে থাকা কেন? আমরা সরকারি না বিরোধী দলে আছি, আমাদের অবস্থান কোথায়- তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। ওই বৈঠকে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, দেশে বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে মনে হয় আমরা একটি ‘পুলিশি রাষ্ট্রে’ বসবাস করছি। পুলিশ যা ইচ্ছে তাই করছে। এতে সরকার সম্পর্কেও জনমনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম সবাইকে ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ১৪ দলের নীতি ও আদর্শ মেনে কাজ করার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ১৪ দলের নীতিমালার বাইরে আমাদের কারোর কোনো বক্তব্য দেওয়া ঠিক হবে না। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটের শরিক জাতীয় পার্টি-জেপি ছাড়া সবাই নৌকা নিয়ে ভোট করে। বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের বিশাল ভরাডুবির পর জাতীয় পার্টি মহাজোটের শরিক হলেও তারা সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করছে। সংসদ নির্বাচনের পরপরই আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা ১৪-দলীয় জোট শরিকদের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে বলে আসছেন। কিন্তু শরিকরা তাতে নারাজ। এ প্রসঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা শেখ হাসিনার কথা বলে জনগণের কাছ থেকে ভোট নিয়েছি। উন্নয়নের কথা বলে ভোট নিয়েছি। এখন সংসদে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের বিরোধিতা করতে পারব না। আমরা জাতীয় পার্টি না।’ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে ‘ভাগ্যবান’ বলা হয়ে থাকে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়াকে। তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর টেকনোক্র্যাট কোটায় শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সারা দেশে সাংগঠনিক তেমন ভিত্তি না থাকলেও আবার মূল্যায়ন চান শরিক দলের এ নেতা। এ প্রসঙ্গে দিলীপ বড়ুয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৪ দলের অনেকেই এমপি হয়েছেন জোটের কারণে। জোট না থাকলে তারা হয়তো এমপি হতে পারতেন না। জোটে অনেক নিবন্ধিত দল আছে, যেসব দল থেকে কেউ এমপি হননি, তাদেরও মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ সবাই জানে ‘ওরা’ ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দল। সে কারণে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের সুযোগ করে দেওয়া হলে নিজ নিজ দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে সক্ষম হবে। এতে ১৪-দলীয় জোট শক্তিশালী হবে।’

২০১৬ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সম্মেলনে দলে বিভক্তি দেখা দেয়। ওই সময়ে অধিবেশন শেষে জাসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বে এক অংশ বেরিয়ে গিয়ে পাল্টা কমিটি গঠন করে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচিত দুজন এমপি শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন অংশে ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। নড়াইলের একটি আসনে শরীফ নূরুল আম্বিয়াকে জোটের মনোনয়ন দেওয়া হলেও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়। ফলে আম্বিয়ার এমপি হওয়া সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ বলে আখ্যায়িত করেন ক্ষমতাসীন জোটের এই অংশের নেতারা। এ নিয়ে জোটের অন্য শরিকরাও চটেছেন তাদের ওপর। সর্বশেষ ১৪-দলীয় জোটের বৈঠকে এ ব্যাপারে ব্যাখা চাওয়া হয় বাংলাদেশের জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধানের কাছে। জোটের এমন টানাপড়েন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জাসদ সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৪-দলীয় জোট সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদবিরোধী জোট। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দেখা না দিলে এই জোটের তৎপরতা দেখা যায় না। এতে জোটে সন্তোষ-অসন্তোষের কিছু নেই। জোট ভাঙার কিছু নেই, থাকারও কিছু নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন কী দেবে? আমাদের নির্ধারিত দুটি সিট ছিল, সেটাও দেয়নি। আওয়ামী লীগে ভর করে লাভ কী?’ তাহলে কি জোট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন- জানতে চাওয়া হলে আম্বিয়া বলেন, ‘না, ১৪-দলীয় জোট সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদবিরোধী একটি প্লাটফর্ম। এটা থাকা উচিত।’ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে এমপি করা হয়েছিল ন্যাপের কার্যকরী সভাপতি আমেনা আহমেদকে। এবার এ দলে কাউকে রাখা হয়নি। এই না রাখা ‘অবমূল্যায়ন’ হিসেবে দেখছেন দলটির নেতারা। এ প্রসঙ্গে ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জোটের রাজনীতিতে দলগতভাবে সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। আশা করি পুনর্মূল্যায়নের পদক্ষেপ নিয়েই সামনের দিকে অগ্রসর হবে প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ।’ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করে। সে সময়ের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের এমপি-নেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। পরে জোটের শরিক দলের নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করে। টানা সাত বছর তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। ২০১২ সালে প্রথম মন্ত্রিসভায় স্থান পান তিনি। সে সময়ে মন্ত্রিসভায় স্থান পান জোটের আরেক শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এবারের নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের সময় সবারই ধারণা ছিল এ দুই নেতার স্থান হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তাদের নিজ নিজ দলে। অন্যদিকে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে ‘অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব’ নিয়ে মুখ খোলেন শরিক দলের নেতারা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর