মঙ্গলবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
বিশেষ সাক্ষাৎকার

নির্বাচন নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে

রাশেদ খান মেনন

নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচন নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ ভোটকে উৎসব হিসেবে নেয়। বয়সের ভারে ন্যুব্জরাও অন্যের কাঁধে ভর করে ভোট কেন্দ্রে যান। এবারও ভোট উৎসব ছিল। তবে অনেক সীমিত ও স্তিমিত। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হলো জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, নির্বাচনে যে ফলাফল আশা করেছিলাম, তার চেয়ে বেশি হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে, এতে সন্দেহ নেই। তবে বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের কথার সঙ্গে আমি একমত নই। তারা যদি এতই জনপ্রিয় হয়, তাহলে নির্বাচনে মাঠে নামল না কেন? গত শনিবার রাজধানীর বিজয়নগরে নিজ কার্যালয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এ কথা বলেন। সংসদে তার দলের ভূমিকা কেমন হবে, জোটের রাজনীতি, ডাকসু নির্বাচন,  প্রভৃতি বিষয়ে তিনি কথা বলেন। রাশেদ খান মেননকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জোট সরকারের সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, আমরা শেখ হাসিনার কথা বলে জনগণের কাছ থেকে ভোট নিয়েছি। উন্নয়নের কথা বলে ভোট নিয়েছি। এখন সংসদে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের বিরোধিতা করতে পারব না। আমরা জাতীয় পার্টি না। তিনি বলেন, আমার বিপরীতে (ঢাকা-৮ আসনে) প্রার্থী ছিলেন বিএনপির মির্জা আব্বাস। আমার এলাকার অনেক নেতার পা কাঁপা শুরু হয়েছিল যে মির্জা আব্বাসকে কীভাবে মোকাবিলা করবে। কিন্তু একদিনও নির্বাচনী প্রচারণায় মির্জা আব্বাসকে মাঠে নামতে দেখিনি। একদিন সেগুনবাগিচা এলাকায় প্রচারণায় নামলেও আর তার দেখা মেলেনি। কোথাও তার পোস্টার ছিল না। শুধু বিএনপি অফিস ও তার শাহজাহানপুর বাসার সামনে পোস্টার দেখেছি। তিনি বলেন, শুধু এখানেই নয়, ধানমন্ডিতে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, মোহাম্মদপুরে সাদেক খানের বিপরীতে কে প্রার্থী তাও জানতাম না। পরে জেনেছি সাদেক খানের বিপরীতে আবদুস সালাম প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু তাকে মাঠে নামতে দেখিনি। তিনি বলেন, বিএনপি প্রথম থেকে নির্বাচনকে বানচাল করা চেষ্টা করেছে। পরবর্তীতে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। এখন বলছে, রাতে ভোট হয়েছে। হতে পারে, তারা অভিযোগ করছে। কিন্তু এসব অভিযোগের প্রমাণ দিতে হবে। এখন পর্যন্ত তারা ৭৪টি মামলা করেছে। যদি সত্যিই রাতে ঢাকা শহরে ভোট হয়ে থাকে, তাহলে এতগুলো মিডিয়ায় কি একটা ছবিও আসবে না? ধরে নিলাম পুলিশ করেছে, তাহলে পুলিশের ভিতরে একজনও কি বিএনপির লোক ছিল না? তারাও তো মোবাইলে ছবি ধারণ করতে পারত। রাশেদ খান মেনন বলেন, নির্বাচনে যদি প্রতিপক্ষ না থাকে তাহলে ভোট আমার পক্ষেই হবে। আমার আসনে কেউ ভোট দিতে এসে ফিরে গেছে এমন নজির নেই। আগের বার (দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন) বলেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন। এখন বলছে ভোট ডাকাতির নির্বাচন। সম্প্রতিকালে তারা বিদেশিদের নালিশ করছে, ধরনা দিচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের কোনো কাজ নেই। তিনি বলেন, আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থার একটা সংস্কার খুবই দরকার। যাতে প্রশাসন, টাকা, মাস্তান নির্বাচনে ব্যবহার না হয়। আমরা দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছি। এমনকি আমরা প্রধানমন্ত্রীকেও বলেছি, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়ে। এটা ঠিক যে ‘এক সের দুধ নষ্ট করতে এক ফোঁটা চোনাই যথেষ্ট। এ ছাড়া আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করেছি। কোনোভাবেই সেই ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত হতে দেব না। রাশেদ খান মেননের কাছে জানতে চাওয়া হয়, গত সরকারের মন্ত্রিসভায় ছিলেন, এবার নতুন মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আপনাদের বলা হচ্ছে বিরোধী দলে যেতে। এখন আপনাদের অবস্থানটা কী? জবাবে রাশেদ খান মেনন বলেন, আমরা ভোট চেয়েছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে। ভোট চেয়েছি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত দশ বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে, সেই উন্নয়নের কথা বলে। এখন সংসদে গিয়ে বিরোধিতা করব? উল্টো কথা বলব? জাপার খেলাটা আমরা করব না। আমরা তো জাতীয় পার্টি না। তিনি বলেন, আমি যখন মন্ত্রী ছিলাম, তখনো সরকারের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরেছি, এখনো তুলে ধরব। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। সম্প্রতি ১৪-দলের বৈঠকে ‘শরিকদের অবস্থান কী জানতে চাওয়া হয়েছে’ তাহলে কি জোটে টানাপড়েন শুরু হয়েছে? জবাবে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি মেনন বলেন, ১৪-দলীয় জোটে টানাপড়েন হয়নি। এটা তো একটি রাজনৈতিক জোট। দলের ভিতরেই অনেক সময় টানাপড়েন হয়। তিনি বলেন, ২৩ দফার ভিত্তিতে জোট গঠন করা হয়েছিল। অনেক লক্ষ্যই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো অনেকগুলো লক্ষ্য সামনে এসেছে। তবে সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে জোট চর্চা হয় না। জোটের শরিকরা দিবসভিত্তিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পান না, কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পায়- এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, গত দশ বছর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় ছিল। দিবসভিত্তিক অনেক অনুষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াত নেতারা দাওয়াতের আমন্ত্রণ পান। ১৪ দলের শরিকরা এই আমন্ত্রণ পায় না। তৃণমূলে এই সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। তার মানে কি দাঁড়ায়? এখনো তৃণমূলে জোটের চর্চা সেভাবে হচ্ছে না। এ নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভগুলো কাজ করে। তিনি বলেন, সবাইকে তো মন্ত্রী-এমপি করা যাবে না। কাউকে কাউকে ব্যাংক, বীমার চেয়ারম্যান কিংবা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। কাউকে কোনো কমিটির প্রধান করা যেতে পারে। ডাকসুর সাবেক এই ভিপির কাছে জানতে চাওয়া হয়, দীর্ঘদিন পর ডাকসুর নির্বাচন হচ্ছে, এই নির্বাচন নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী? জবাবে তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আশা করি, সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ভোট হবে। তবে এখন কিছু কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যেমন একাডেমি ভবনে ভোট নিয়ে আসা, শ্রেণিকক্ষে নির্বাচনী প্রচারণাসহ বেশকিছু দাবি। এসব নিয়ে নির্বাচন বিতর্কিত করার কোনো অবকাশ নেই। তবে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য এটা ‘টেস্ট কেস’। ডাকসুর নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই এবং মারামারির ঘটনা এর আগে ঘটেছে। আমি মনে করি, ডাকসুর এই নির্বাচনের ওপর নির্ভর করবে সব ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ফলাফল ও অংশগ্রহণ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের উচিত সহাবস্থান বজায় রাখা। সংরক্ষিত নারী আসনে আপনার স্ত্রীকে এমপি করা হয়েছে, এটা নিয়ে দলের ভিতরে এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে-এ ব্যাপারে কী বলবেন, জবাবে রাশেদ খান মেনন বলেন, দলের সংসদীয় বোর্ড আছে, পলিটব্যুরোর আছে। সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী তো একদিনের রাজনীতিবিদ না। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই শুধু নয়, আমার দলের মহিলা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। আমার পরিবার চালাতে গিয়ে তাকে চাকরি করতে হয়েছে। এটা তো দোষের কিছু না। এ নিয়ে ক্ষোভের কিছুই নেই। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত আমাদের ছেড়ে কথা বলবে না। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও রায় কার্যকর করা সবচেয়ে বড় কাজটি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে শুধু জামায়াতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নয়, পাকিস্তান, সৌদি আরব এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ তারা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। কাজেই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। মেনন বলেন, মানুষ যখন স্বস্তি পেয়ে যায়, তখন আশা-আকাক্সক্ষাও বেড়ে যায়। তখন মানুষের মধ্যে অস্থিরতাও বাড়ে। ফলে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে যায়। এই বিষয়গুলো সামনে রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে ও সতর্কভাবে এগোতে হবে।

সর্বশেষ খবর