বুধবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিদেশের কারাগারে বন্দী ১৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি

সাত বছরে বেড়েছে তিন গুণ, সরকারি তথ্যে গড়মিল

জুলকার নাইন

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক রয়েছেন প্রায় ১৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি নাগরিক। গত সাড়ে সাত বছরে বিদেশের কারাগারে বন্দী বাংলাদেশির এই সংখ্যা প্রায় তিন গুণ হয়েছে। ২০১২ সালের জুন মাসে বিদেশের কারাগারে বন্দী বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে চার হাজার। অবশ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে ঠিক কত সংখ্যক বাংলাদেশি আটক ও বন্দী রয়েছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই কোথাও। কিন্তু প্রতিদিনই বাড়ছে এই সংখ্যা। নতুন যুক্ত হয়েছে প্রবাসে মাদক ব্যবসার সঙ্গে বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ততার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়া। বিদেশের কারাগারে বন্দী এসব নাগরিককে ছাড়িয়ে আনার বিষয়ে বাংলাদেশের মিশনগুলো কাজও করছে। তারপরেও বছরের পর বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক বাংলাদেশিরা নিঃস্ব হয়ে ফিরছেন। অনেকে মৃত্যুর মুখেও পড়ছেন। প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, প্রতিদিনই প্রচলিত ও অপ্রচলিত পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। ভাগ্য বদলের আশায় তারা বৈধ পথের পাশাপাশি যাচ্ছেন অবৈধ পথেও। অনেকেই গিয়ে আটক হচ্ছেন সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। আবার অনেকে মেয়াদ শেষে বাড়তি অবস্থান করে অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন। বেশির ভাগই লুকিয়ে থেকে কাজ করছেন। কেউ কেউ গ্রেফতার হচ্ছেন। আবার   কোনো কোনো বাংলাদেশি জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধে। প্রবাসের মাটিতে চুরি, মাদক পাচার  থেকে শুরু কওে রোমহর্ষক খুন পর্যন্ত করছেন বাংলাদেশিরা। অবশেষে ঠাঁই হচ্ছে বিদেশের কারাগারে। বতর্মানে বিশ্বের ৪২টি দেশে ১৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি বন্দী হয়ে আছেন। তবে এই সংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। পরিসংখ্যানের চেয়ে সংখ্যা এত বেশি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে তার ব্যাখ্যায় ঢাকার একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার কর্মকর্তা জানান, গত সাত বছরে সরকারের পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আটক ও বন্দীর সংখ্যা পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজারের মধ্যে উল্লেখ করে সংসদে তথ্য দেওয়া হয়েছে। আবার একই সংসদে লিখিতভাবে ২০১২ থেকে ২০১৭ সালে বিদেশের কারাগার থেকে সাড়ে ৪৯ হাজার বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার তথ্য দেওয়া হয়। সংসদের নথি অনুসারে, ২০১৩ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিখিত প্রশ্নোত্তরে জানান, বিশ্বের ৪৭টি দেশের কারাগারে ৪,৫৩২ জন বাংলাদেশি নাগরিক আটক আছেন। ২০১৪ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় ৭,৮৫৯ জন আছেন বিদেশের কারাগারে। ২০১৫ সালে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী সংসদে তথ্য দেন বিদেশের কারাগারে আছে ৪ হাজার ৫৭৭ জন। আবার ২০১৬ সালের ৬ জুন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী সংসদে লিখিত বক্তব্যে জানান, ২০১২-১৬ সাল পর্যন্ত বিদেশের কারাগার থেকে সাড়ে ৪৯ হাজার ৫০৩ জন বাংলাদেশি মুক্তি  পেয়েছে। তিনি কোন দেশ থেকে কতজন মুক্তি  পেয়েছেন তার পরিসংখ্যানও উল্লেখ করেন সংসদে। মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস কর্তাদের দাবি, পাসপোর্ট ভিসার জটিলতা ও অপরাধের কারণে কারাগারে যাওয়া দুই ধরনের বিষয় হিসেবেই ধরা হয়। আবার সবসময় কতজন বাংলাদেশি বিদেশের কারাগারগুলোয় বন্দী বা আটক আছেন তার  কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়াও কঠিন। আটকদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বাংলাদেশ মিশনে যোগাযোগ করলেই কেবল তাদেও খোঁজ রাখা সম্ভব হয়। বিদেশে কোনো নাগরিক কারাগারে গেলে অনেক সময় দেশ থেকে স্বজনরা ঢাকায় প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে থাকেন। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মিশন থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। আবার কারাগারে আটক ব্যক্তিরা ছাড়া পেলে  বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বজনদেরই বিমান ভাড়া বহন করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় অনেক সময় লেগে যায়। এ ছাড়া এক এক দেশের আইন একেক রকম। আইনি পদক্ষেপ শেষে কারাগার থেকে আটক ব্যক্তিদের উদ্ধারে অনেক সময় লেগে যায়। আইনগত জটিলতা থাকার কারণে অনেকে সহজেই কারাগার থেকে মুক্তি পান না। অনেক  দেশে নেই মিশনও। তাই তালিকার বাইরেও থেকে যান অনেক বন্দী। তবে খোঁজ পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। উদ্ধারের গতি শ্লথ হলেও  চেষ্টা ও উদ্যোগ উভয়ই আছে সরকারের। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কূটনীতিকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে মদ, গাঁজা ও ইয়াবা সম্পর্কিত অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যেখানে মাদক ব্যবসা সর্বোচ্চ সাজার অপরাধ  সেখানে এ ধরনের অপরাধ করা আবার শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সর্বোচ্চ মাদকের চালানের সঙ্গে বাংলাদেশিদের জড়িয়ে পড়াকে অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন তারা। কাতার দূতাবাসের তথ্য, কাতারের কারাগারে বর্তমানে সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশি আসামির সংখ্যা ১৪৯ জন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসামি সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন মদ-গাঁজা সম্পর্কিত অপরাধের দায়ে। এমন অপরাধে ৩ থেকে ৫ বছর মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ৭০ জন। যৌন হয়রানির অপরাধে এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি রয়েছেন সাতজন। এ ছাড়া নেশাজাতীয় ওষুধ বহন বা  সেবনের অপরাধে দি ত কয়েদি আছেন দুজন। এর বাইরে অন্যান্য অপরাধেও বেশ কজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি রয়েছেন। এতে কাতারে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও আশঙ্কা তাদের। কাতারে কারাবন্দী বাংলাদেশিদের গুরুতর অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ১৪৯ বাংলাদেশি ছাড়াও পাসপোর্ট-ভিসাসহ নানা জটিলতায়  দেশটির সফর জেলে ৯৩ বাংলাদেশি আটক রয়েছে। পররাষ্ট্র দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, কাতারের এই ‘সফর’ জেলে আটক থাকাদের মতো অন্য আরও কয়েকটি দেশেও অভিবাসন বা অবৈধ অবস্থান সংক্রান্ত অপরাধে আটকদের সংখ্যাটা বেশ বড়। এদের পরিচয় নিশ্চিত করতে সময় লাগায় তাদের কারাগারে রাখা হয়। পরে অনেকে জরিমানা দিয়ে ফেরে আবার অনেকে জরিমানা না দিতে পারলে কারাগারে আটক থাকে।

অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে কাজ করা ‘রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিচার্স ইউনিট’ (রামরু) এর চেয়ারম্যান ড. তাসনীম সিদ্দিকীর মতে, শুধু দূতাবাস কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কারাবাসে থাকা বিশালসংখ্যক প্রবাসী কর্মীদের মুক্ত করা কঠিন। এ জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করার বিকল্প নেই।  যেসব দেশে আটক রয়েছে, ওই সব দেশের বাংলাদেশি কমিউনিটি লিডারদের একত্র করেও সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশের যে তিনটি  মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের সমন্বয় জরুরি।

সর্বশেষ খবর