বৃহস্পতিবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাংলা ভাষা বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন জরুরি

আ স ম মাসুম, লন্ডন

বাংলা ভাষা বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন জরুরি

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

অমর একুশে গানের রচয়িতা, ভাষাসৈনিক, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন, স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা নিয়ে যতটুকু গবেষণা হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। তাঁর মতে, বাংলাদেশে বাংলা ভাষা বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি।

সম্প্রতি লন্ডনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, বাংলা ভাষা সাহিত্যের ভাষা হিসেবে পৃথিবীর যে কোনো প্রথম শ্রেণির ভাষার সমতুল্য। তবে ব্যবহারিক দিক দিয়ে যতটুকু বিশুদ্ধ ভাষা হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। শতভাগ বাংলা ভাষায় কোনো ডিপ্লোমেটিক বা কমার্শিয়াল চিঠি লেখা যায় না। ভাষা এবং পরিভাষা নিয়ে গবেষণা না হলে অন্য ভাষা থেকে নিয়ে আসা শব্দ যেভাবে ঝাঁকিয়ে বসছে তাতে ব্যবহারিক ভাষা থেকে বাংলা শব্দ হারিয়ে যাবে। ভাষা অবশ্যই ব্যবহারিক ভাষা হওয়া দরকার। সাহিত্যের ভাষা দিয়ে কথোপকথন চলে না। তিনি বলেন, ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মতো। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হবে। বাংলা ভাষা প্রথম যখন তৈরি হয় তখন আরবি ও ফারসি শব্দের ছড়াছড়ি ছিল। পরবর্তীতে হিন্দু বনেদিদের কারণে ব্যবহারিক ভাষায় প্রচুর পরিমাণে সংস্কৃত ভাষা ঢুকেছে। আলীগড় শিক্ষা বিপ্লবের পর বাংলাদেশে যখন মুসলিম পি ত তৈরি হওয়া শুরু হলো তখন প্রচুর পরিমাণে আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দ ঢুকেছে। ঠিক এভাবেই বর্তমানে এসে প্রচুর ইংরেজি শব্দ দখল নিয়েছে ব্যবহারিক বাংলা ভাষায়।

তবে বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক যেভাবে নিজস্ব ভাষা ও বানান রীতি তৈরি করে নিজস্ব একটি রীতি চালুর চেষ্টা করছে সেটিও অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এমনকি বাংলা একাডেমিও যে বছরে বছরে বানান শুদ্ধ করছে সেটিও কোনো কাজের নয়। এজন্য সরকারের উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাষা বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র চালু করা।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী স্মৃতিচারণ করে বলেন, পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষার এমন বিকৃতি ঘটেছিল যে সেটি আর মানা যায়নি। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সে সময় একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হতো, ‘ফজরে উঠে কম জোর মালুম হইলে এক গ্লাস হরলিকস পিয়ে লিন।’ অথচ বিজ্ঞাপনের ভাষা হওয়া উচিত ছিল, ‘সকালে উঠিয়া যদি দুর্বল বোধ করেন তাহলে এক গ্লাস হরলিকস পান করুন।’ রেডিও পাকিস্তানে বাংলায় নিউজে বলা হতো, ‘আজ উজিরে খাজানা ঢাকায় হাওয়াই আড্ডায় তশরিফ নেবেন।’ এ রকম একটি অবস্থায় রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই আন্দোলনের সূচনা হয়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি লেখার প্রেক্ষাপট হিসেবে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, ‘তখন আমি ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র এবং সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। সেদিন আমিও অন্যদের মতো আমগাছ তলায় মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন গোলাগুলি হয়। তখন আমি, আমার ক্লাসফ্রেন্ড শফিক রেহমান, ড. রফিকুল ইসলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজে লাশ দেখতে যাই। রফিকুল ইসলামের একটি ক্যামেরা ছিল। আউটডোরে রফিকের লাশটি পড়া ছিল। ছবি তুলল আমাদের বন্ধু রফিক। ওই চেহারা দেখে আমার মনে হলো এইটা আমার বড় ভাই। ফেরার সময় শফিক রেহমানের সাইকেলের পেছনে বসে ৫-৬ লাইন কবিতা দাঁড় করালাম। এরপর ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখি সব ছাত্রাবাস বন্ধ। তখন শফিক রেহমানের বাবা ছিলেন ঢাকা কলেজের প্রফেসর। শফিক রেহমানের বাসায় গেলাম। সেখানে বসে লিখলাম আরও কিছু লাইন। তারপর চলে যাই দাউদ খান নামে আমার আরেকজন বন্ধুর বাসায়। সেখানে গিয়ে পুরোটা শেষ করি।’ তিনি বলেন, ‘১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে এটি প্রথম সুর করে গাইলেন আবদুল লতিফ ভাই। এরপর আমাদের ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিছুদিন পরে বহিষ্কারাদেশ তোলা হয়। এরপর হাসান হাফিজুর রহমান একুশের এক সংকলনে কবিতাটি ছাপেন। সেটিও নিষিদ্ধ করা হয়। তারপর আমার ক্লাসফ্রেন্ড জহির রায়হান তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’তে এই গান ব্যবহার করেন। তখন এটি নতুন করে সুর করেন আলতাফ মাহমুদ। এভাবেই গানটি জনপ্রিয়তা পায়। বর্তমানে এই গানটি ১১টি ভাষায় গাওয়া হয়।’

তবে সময়ের সঙ্গে ভাষার যে পরিবর্তন হচ্ছে এটিকেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বর্ষীয়ান এই সাংবাদিক। তিনি বলেন, আগে একটি শব্দের একটি অর্থ হতো। এখন বহু অর্থ বের হচ্ছে। এটি অবশ্যই একটি ভাষার জন্য প্রয়োজন। এক সময় আমরা শহীদ বললে শুধু বুঝতাম ধর্মের জন্য যারা মারা গেছেন তাদের। কিন্তু কমিউনিস্টরা এসে এটিকে ব্যবহারিক দিক দিয়ে অন্য অর্থ দিল। এখন যে কোনো আন্দোলনে মারা গেলেই আমরা তাকে শহীদ বলে থাকি। বাংলা ভাষা ব্যবহারের দিক থেকে এখন অনেক ছোট বাক্যে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। নতুন যারা লিখছেন তাদের লেখায় ভাষার ব্যবহার অনেক সমৃদ্ধিশালী। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৈরি করা শব্দের বাইরে এখন পর্যন্ত কেউ আসতে পারছেন না বলে মনে করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর