শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

আগুনের ভয়াবহতা বাড়িয়েছে কেমিক্যাল

তদন্ত কমিটির কাজ শুরু, পাঁচ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা

সাখাওয়াত কাওসার

আগুনের ভয়াবহতা বাড়িয়েছে কেমিক্যাল

আবারও সেই কেমিক্যাল! গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুনের সূত্রপাত হলেও উচ্চ দহনশীল কেমিক্যালের স্পর্শেই আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন তদন্ত কমিটি এ ধরনের তথ্য পাওয়ার পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় কেমিক্যালের বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও গতকাল চকবাজারের চুড়িহাট্টার সেই ‘ওয়াহিদ ম্যানশন’-এর পুরো বেসমেন্টেই কেমিক্যালের গোডাউনের সন্ধান পেয়ে রীতিমতো চোখ চড়ক গাছ সংশ্লিষ্টদের। অন্যদিকে, ওয়াহিদ ম্যানশনের বিভিন্ন ফ্লোরে ১১ ধরনের কেমিক্যালের অস্তিত্ব পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স। পাঁচটি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টাঙিয়ে দিয়েছে রাজউক ও ফায়ার সার্ভিস। এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চকবাজার থানায় দুটি মামলা হয়েছে। ঘটনার উৎস ও কারণ অনুসন্ধানে গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সুরক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, অগ্নিকাণ্ডে সরকারি সংস্থার কোনো অবহেলা আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে। গতকাল বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনাদের এ প্রশ্ন আমার টার্মস অব রেফারেন্সে আছে। আমরা পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি যখন কাজ করব তখন বিভিন্ন জনের কাছে যাব, ঘটনায় কী কী বিষয় কাজ করেছে, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। এজন্যই এখানে আসা।’ অতীতে এ রকম অনেক ঘটনা ঘটেছে, যার কোনো তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখই দেখেনি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আলোর মুখ অবশ্যই দেখবে, এজন্যই এসেছি।’ এ সময় কমিটির অন্য সদস্য ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার ইব্রাহীম খান বলেন, ‘এখনো সঠিক কারণ নির্ণয় করতে পারিনি। এ মামলার আলোকেই তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেব। তদন্ত রিপোর্ট আপনাদেরও জানানো হবে।’ গতকাল সকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিস্ফোরক পরিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরের তদন্ত দলের সদস্যরা ওয়াহিদ ম্যানশনের বেসমেন্টে ড্রামভর্তি কেমিক্যাল থাকার প্রমাণ পান। গতকাল সকালে সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কাক-ভোর থেকেই সেখানে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করছেন। পুড়ে যাওয়া জিনিস সরিয়ে ফেলছেন। তবে এলাকাবাসীর চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। বহু মানুষ সেখানে ভিড় জমিয়েছেন অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া এসব ভবন দেখতে। মাঝেমধ্যেই তাদের সরিয়ে দিতে হুইসেল বাজাচ্ছে পুলিশ। একপর্যায়ে পুলিশ পাঁচ রাস্তার মোড়ে ওই ভবনের সামনের রাস্তাগুলোয় দড়ি দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে দেয়। এরই মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্য রতন ওয়াহিদ ম্যানশনের বেসমেন্টে কেমিক্যালের গোডাউনের অস্তিত্ব খুঁজে পান। ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছেন, ওয়াহিদ ম্যানশনের বেসমেন্টে ১১ ধরনের কেমিক্যালের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলো হলো কোরিয়ার তৈরি ২০ কেজি ওজনের প্লাস্টিকের অনেক প্যাকেট, ৩২২০ অয়েল অরেঞ্জ জি ২৫-২৮ কেজির ড্রাম, (ড্রামে লেখা ছিল মেড ইন চায়না, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউজ অনলি), অ্যাসিড (গ্রিন ৫জি ৫০ পারসেন্ট) ২৭ কেজি ও অয়েল রেড বিআর ২৪ কেজি। মেটাল পাউডার (গোল্ড ব্রোঞ্জ পাউডার ২৫ কেজি মেড ইন অস্ট্রেলিয়া। পিগমেন্ট টি রেড ২৫ কেজি, পিভি ফাস্ট গ্রিন ২৫ কেজি, পিগমেন্ট রেড ২৫ কেজি, ইয়োনিক ইয়োলো ২৫ কেজি, সিলভার হোয়াইট এপি ৫১০৬-৫০%, ২৭ কেজি। ব্লু স্টার/আলট্রা মেরিন ২৫ কেজি, পিগমেন্ট অরেঞ্জ ৩০% ২০ কেজি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কর্তৃক গঠিত ১১ সদস্যের কমিটির অন্যতম সদস্য ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, ‘ভবনের ভিতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের ক্যানেস্তারা ছিল। এটা একটা দাহ্য পদার্থ। এ ছাড়া আরও অন্য কেমিক্যাল ছিল। প্রতিটি জিনিসই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হতো এখানে। সেই বোতলগুলো ব্লাস্ট হয়ে বোমার মতো কাজ করেছে।’ বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক সামসুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতিটি কেমিক্যালই আগুনে দাহ্য। আগুনের গতি বাড়িয়ে দিতে পারে।’ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কেমিক্যাল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা ঢাকতে শিল্প মন্ত্রণালয় তড়িঘড়ি করে প্রতিবেদন দিয়েছে। এত বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এত অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব নয়। আর সরকারের নির্দিষ্ট একটি বিভাগ- ফায়ার সার্ভিস রয়েছে অগ্নিকা  নিয়ে কাজ করার জন্য। যে কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ বিভাগ পুরো বিষয়টি সরেজমিন দেখে প্রাথমিক প্রতিবেদন দেবে। ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্ধার অভিযান শেষ হওয়ার মাত্র ৬ ঘণ্টার মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাথমিক প্রতিবেদনে বিষয়টি নিশ্চিত করে। তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে শিল্পমন্ত্রী নিজেও কেমিক্যাল নয়, গ্যাসের কারণে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি গণমাধ্যমের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক আবু নাঈম মো. শহিদুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এমন স্পর্শকাতর ঘটনায় সঠিক তদন্ত না করে কারও মন্তব্য করা ঠিক নয়। চকবাজারের আগুনের ঘটনার কারণ অল্প সময়ে বের করা সম্ভব নয়।’ ডিএসসিসি তদন্ত কমিটির সদস্য বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার বিম ও কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনের সাপোর্ট ধরে রাখতে পারবে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।’    

 

সর্বশেষ খবর