রবিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

কাগজ চোরাকারবারিতে চার প্রতিষ্ঠান

বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধায় আনা কাগজ খোলাবাজারে

রুহুল আমিন রাসেল

রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল-ইপিজেড ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার বিপুল পরিমাণ কাগজ চোরাকারবারিতে জড়িত চার প্রতিষ্ঠান। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে কালোবাজারে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আত্মসাৎকারী এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে। তথ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রের। ইপিজেড ও কাস্টমস সূত্র জানায়, সম্প্রতি মোংলা ইপিজেডের মুন স্টার, সৈয়দপুর ইপিজেডের ফারদিন এক্সেসরিস ও কোয়েস্ট এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের ওয়েবকোয়াট নামের এই চারটি বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত কাগজ জাতীয় পণ্য রাজধানীর নয়াবাজারে কয়েক দফা বিক্রি করেছে। এর আগেই এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ে। কিন্তু কোনো ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় আবার চোরাকারবারিতে জড়িয়ে পড়েছে ওই চার প্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, মোংলা ইপিজেডের প্রতিষ্ঠান মুন স্টারের মালিক অত্যন্ত প্রতাপশালী। তার একাধিক প্রতিষ্ঠানের রয়েছে বন্ড লাইসেন্স। এর আগে কাগজ জাতীয় পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির অপরাধে ওই প্রতাপশালী ব্যক্তির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে কয়েকটি মামলা করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। তবুও থামেনি চোরাচালান। সম্প্রতি মুন স্টার কাগজের একটি বড় চালান কালোবাজারে বিক্রি করেছে বলে নিশ্চিত করেছে মোংলা ইপিজেড ও কাস্টমস সূত্র। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনার সুরেশ বিশ্বাস গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মুন স্টার কালোবাজারে পণ্য বিক্রি করে পার পাবে না। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে খতিয়ে দেখব। তার দাবি- ইপিজেডের রেজিস্টার পণ্যের তালিকা লিপিবদ্ধ থাকার কথা। সেখানে এমন ঘটনা কাম্য নয়। মোংলা ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক জিএম মাহবুব আহমেদ সিদ্দিকী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি এখানে নতুন। মাত্র ৭- ৮ মাস আগে এসেছি। তবে মোংলায় কাস্টমসের সহকারী কমিশনার পারভেজ আল জামান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখব। মিথ্যা ঘোষণা দেওয়া হলে জরিমানা করা হবে। বন্ড লাইসেন্সধারী কেরানীগঞ্জের প্রতিষ্ঠান ওয়েবকোয়াট প্রসঙ্গে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার এস এম হুমায়ুন কবির গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও চোরাচালানের দায়ে ওয়েবকোয়াটের বিরুদ্ধে মামলা চলমান। আশা করছি, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। সৈয়দপুর ইপিজেডের ফারদিন এক্সেসরিস ও কোয়েস্টের শুল্কমুক্ত পণ্য কালোবাজারে বিক্রির সঙ্গে ইপিজেড কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন সৈয়দপুর ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক জিএম আকতার আলম মুসতারি। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সৎভাবে চাকরি করছি। আমাদের অনুমোদন ছাড়া কোনোভাবেই শুল্কমুক্ত সুবিধা আমদানি পণ্য কেউ খোলাবাজারে বিক্রি করতে পারে না। ফারদিন এক্সেসরিস ও কোয়েস্ট কালোবাজারে কাগজ পণ্য বিক্রি করেছে, এটা সঠিক নয়।

এ প্রসঙ্গে রংপুরের কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ আহসানুল হকের বক্তব্য জানতে চেয়ে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট জানিয়েছে, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও বন্ডেড পণ্য চোরাইপথে খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার পণ্য জব্দ করেছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। ওই দিন রাতে রাজধানীর গুলিস্তান ও বিরুলিয়া বেড়িবাঁধ এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাতটি কাভার্ডভ্যানও জব্দ করে কাস্টমস। এ অভিযানে ফারদিন এক্সেসরিসসহ ছয় প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার পণ্য জব্দ করা হয়। এর আগেও বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত পণ্য এনে দেশের খোলাবাজারে অবৈধভাবে বিক্রি করেছে মেসার্স ফারদিন এক্সেসরিস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির এই অনিয়ম সম্পর্কে ২০১৫ সালে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়- ফারদিন এক্সেসরিস জিপিপিএস, এইচআইপিএস, পিভিসি রেজিন, পিইটি রেজিন, প্যারাফিন ওয়াক্স, পিপি, এইচডিপিই, এলডিপিই, এলএলডিপিই, বিওপিপি, ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ডসহ ২৫ ধরনের কাঁচামাল এনে বিক্রি করেছে ৩৫ কোটি ৪০ লাখ ৮৮ হাজার টাকায়। এতে সরকার রাজস্ববঞ্চিত হয়েছে ১২ কোটি ৯ লাখ টাকা। ফারদিন এক্সেসরিস লি. একটি নব্য অনুমোদনপ্রাপ্ত বন্ডেড প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট, রংপুর কমিশনারেট একটি সাময়িক বন্ড লাইসেন্স প্রদান করেছে, যার নম্বর ০৪/২০১৪ তারিখ ১৪-০৭-২০১৪। প্র্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধার আওতায় বিনা শুল্কে আমদানি করা কাঁচামাল উৎপাদনে ব্যবহার না করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত বন্ডেড ওয়্যার হাউসে গিয়ে দেখা যায়, গেটের কাছে রাখা পিপি দানার লটের চারপাশটা দুই-তিন স্টেকে কাঁচামালের ব্যাগ দিয়ে সাজানো। কিন্তু এর মধ্যবর্তী স্থানটি ফাঁকা। বাইরের ব্যাগগুলো না সরালে যা দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা নয়। এতে বাহ্যিক দৃষ্টিতে স্টেকগুলো পরিপূর্ণ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এ পদ্ধতিতে ব্যাগগুলো সাজানো হয়েছে তদন্ত কমিটিকে ধোঁকা দিতে। পাশাপাশি ইপিজেড কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ইস্যু করা আমদানি ও রপ্তানি দলিলপত্র সংগ্রহ করা হয়। সেখানেও অনিয়ম পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা আছে, তদন্তকালে যে ৪৮টি আমদানি চালানের তথ্য পাওয়া যায়, তার মধ্যে কাঁচামাল খালাস-সংক্রান্ত কোনো বি/ই সরবরাহ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন পরিচালনাকারী ব্যাংকও কোনো রপ্তানি এলসি পায়নি। ব্যাংক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক ২৬-১০-১৪ তারিখে দুটি বি/ই (নং-সি ৯৬৫৩৬ ও সি ৯৬৫৪৫) এবং ২৭-১০-১৪ তারিখে চারটি বি/ই (নং-সি ৯৭১৯৩, সি ৯৭২০৭, সি ৯৭২১১ ও সি ৯৭২১২)-এর মাধ্যমে যেসব কাঁচামাল আমদানি হয়েছে তার এন্ট্রিও পাওয়া যায়নি রেজিস্টারে। ২৯-১০-১৪ তারিখে একটি বি/ই (নং-সি ৯৮৫৩০)-এর মাধ্যমে যে কাঁচামাল আমদানি হয়েছে তাও বন্ড রেজিস্টারে ইন টু বন্ড করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি চালানগুলোর বিপরীতে কোনো বিল অব এক্সপোর্ট ইস্যু করেনি। এ প্রসঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তখনকার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেছিলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে বড় মাপের অনেক প্রতিষ্ঠান খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করছে। এতে দেশীয় শিল্প, বিশেষভাবে কাগজশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর