শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

পাকিস্তানের হার মানা যত যুদ্ধ

এম জে আকবর

পাকিস্তানের হার মানা যত যুদ্ধ

ইতিহাস বলে, জিব্রালটার ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বশেষ ঘাঁটি, যে ঘাঁটির তৎপরতা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে হংকং পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতীয়দের জন্য জিব্রালটার হওয়া উচিত জাতীয় স্মৃতির অমোচনীয় অংশ। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান তার ৭২ বছরের জিহাদে পাকিস্তানে ‘জিব্রালটার’ কথাটা দুবার ব্যবহার করেছিল।

কোনো কোনো মহলে একটা ভুল ধারণা চালু আছে যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে চূড়ান্ত পরাজয়ের পর থেকে পাকিস্তান ‘অন্য উপায়ে যুদ্ধ’ বা ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ চালিয়ে থাকে। সেই ১৯৪৭-এর অক্টোবর থেকে সেনা আকারে ও ক্ষুদ্র সেল গঠন করে তাদের সন্ত্রাসবাদীদের ব্যবহার করে চলেছে পাকিস্তান। পাকিস্তান প্রথম যে আঘাত হানে তার নাম দেয় ‘জিহাদ’ এবং জিহাদ করতে যাদের জোগাড় করে, তাদের অনুপ্রাণিত করতে শব্দটি ব্যবহার করে। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে দিব্যতান্ত্রিক বাক্য, কপটতা, অপলাপ, মিথ্যা বর্ণনা, আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ও প্রতারণামূলক কূটনীতি এবং গোপন সন্ত্রাস সমন্বয়ের মাধ্যমে কাশ্মীর দখলের চেষ্টা করছে পাকিস্তান।

১৯৪৭-এ যে চাতুরী অবলম্বন করেছিল, আজ ২০১৯-এও তা-ই করছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব তার জনসাধারণের সামনে না-জানার ভান করে আর গোপনে কুকাজে সায় দেয়। পাকিস্তান আর্মি কাশ্মীরে সহিংসতা ঘটিয়ে দাবি করে ওটা ‘গণঅভ্যুত্থান’। অথচ জঙ্গি ক্যাম্পে তাদের অফিসার ও সেনারা সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ দেয়। সাংকেতিক নাম ‘জিব্রালটার’ ব্যবহার না ছিল তৎক্ষণাৎ, না ছিল দুর্ঘটনাজনিত। জিব্রালটার হচ্ছে জাবালুত তারিক-এর অপভ্রংশ, আরবিতে যার মানে ‘তারিকের পর্বত’। তারিক বিন জায়েদের নেতৃত্বে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে বেরবের মুসলিমদের ছোট একটি সেনাদল ১৩৯৮ ফুট উঁচুউঁচু শিলা দ্বারা গঠিত এই ক্ষুদ্র স্পেনীয় দ্বীপে অবতরণ করে। জায়গাটি ভূমধ্যসাগরের উত্তর মুখে অবস্থিত। তারিক প্রথমে যে কাজটি করলেন, তা হচ্ছে তার সৈন্য-সামন্ত বহনকারী জাহাজটি তিনি পুড়িয়ে দিলেন। বার্তা পরিষ্কার- হয় জয়, নয় তো মৃত্যু। ভিজিগোথদের ওপর তারিকের ঐতিহাসিক জয় আইবেরিয়ান উপদ্বীপে আরব শাসনের সূচনাভূমি তৈরি করে দেয়, যে শাসন চলেছিল সাড়ে সাত শ বছর, অর্থাৎ ১৪৬২ সালে আলহামরায় মুসলিম রাজত্বের শেষ দিন পর্যন্ত।

যে পাকিস্তানি সেনা অফিসার জম্মু-কাশ্মীরে প্রথম আক্রমণের পরিকল্পক ও অভিযানে নেতৃত্ব দেন, তার নাম কর্নেল আকবর খান। তিনি ছিলেন রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা সদর দফতরের পরিচালক (অস্ত্র ও সরঞ্জাম)। যেহেতু এই অভিযানের মূলে ছিল শঠতা, তাই তার নাম দেওয়া হয় ‘জেনারেল তারিক’। ১৯৪৭-এ সরকার ও আর্মি যা করেছিল, আজ ২০১৯-এ এসেও তারা তা-ই করছে। তা হলো ঘটনা ঘটিয়ে দায় অস্বীকার করা।

পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র প্রথম কৌশলগত সিদ্ধান্ত ছিল যুদ্ধের মাধ্যমে রাজাশাসিত জম্মু ও কাশ্মীর দখল করা। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত ছিল, যুদ্ধটা হবে সন্ত্রাসবাদী যুদ্ধ। এটি ঘোষণা দিয়ে নেমে পড়া যুদ্ধ হবে না। এর দায়িত্ব পেলেন ‘জেনারেল তারিক’। যখন যুদ্ধ শুরু হলো, কর্নেল খানকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সামরিকবিষয়ক উপদেষ্টা পদে বসানো হলো। উদ্দেশ্য, প্রধানমন্ত্রী ও আগ্রাসীদের মধ্যকার কমান্ডের রাস্তা মসৃণ করা।

প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দীর্ঘ এক বৈঠকে ‘কাশ্মীরে সশস্ত্র বিদ্রোহ’ নামে অভিযানের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়। অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ বৈঠকে অল্প সময়ের জন্য যোগ দেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের আশঙ্কার বর্ণনা দেওয়া কর্নেল এম শের খানের পেশকৃত সামরিক গোয়েন্দাতথ্য বৈঠকে মূল্যায়ন করা হয়। বৈঠক মনে করে, কাশ্মীরে শীতের কারণে ১৯৪৮-এর বসন্তে ভারতীয় হস্তক্ষেপ সম্ভব নয়।

পরিকল্পনা ছিল, সীমান্ত অঞ্চল থেকে সংগৃহীত পাঁচ হাজার উপজাতিকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেওয়া হবে। এরা কাশ্মীরি সেজে সন্ত্রাসের পক্ষে কথা বলবে আর জজবা তুলবে ‘স্বাধীনতা চাই’। মহারাজা হরি সিংয়ের ‘হিন্দু শাসন’ থেকে মুক্তি চাই।

এই যে চাতুর্যপূর্ণ একটি পরিকল্পনা, এটি পরে নিশ্চিত হওয়া যায় একটি ব্রিটিশ সূত্র থেকেও। স্যার জর্জ কানিংহাম, পরে যিনি উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশের গভর্নর ছিলেন, ১৯৪৭-এর ১৭ অক্টোবর তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, তিনি তার অধীন কর্মচারীর কাছ থেকে জানতে পারেন, ‘কাশ্মীরের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য হাজারা এলাকায় সত্যি সত্যি আনাগোনা চলছে’। অভিযানের জন্য যে রাইফেল সংগ্রহ করা হয়েছিল, তার বিস্তারিত উল্লেখ ছিল। যেভাবে এসব রাইফেল পাওয়া গিয়েছিল তা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানি মানসিকতার চিত্র তুলে ধরে। আক্রমণকারীরা চেয়েছিল ৫০০ রাইফেল। কিন্তু কর্নেল খান জানতেন এটি খুবই অপর্যাপ্ত। তিনি তখন স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় পাঞ্জাব পুলিশের জন্য ৪ হাজার রাইফেল বরাদ্দ করলেন এই যুক্তিতে যে, এগুলো চলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধে পুলিশের জন্য সহায়ক হবে। কিন্তু দাঙ্গা নয়, পাকিস্তানের জন্য অগ্রাধিকার ছিল কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ।

২০ অক্টোবর ১৯৪৭, জম্মু ও কাশ্মীরের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে পাকিস্তান। ২৩ অক্টোবর ভোরে, স্বাধীনতার নয় সপ্তাহ পর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পাকিস্তান প্রথম জিহাদ শুরু করল। পাকিস্তান ইতিমধ্যে তার ঐশিক জিনের প্রতি সাড়া দিল।

লিয়াকত আলী খানের ভূমিকা বিতর্কিত ছিল না। কিন্তু জিন্নাহ্্ কিছুসংখ্যক স্তাবক লিয়াকতকে তার দায়িত্বকাঠামোর বাইরে রাখার চেষ্টা করেন। ১৯৯১-এর আগস্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন জেনারেল আসিফ নওয়াজ। আসিফের ভাই সুজা নওয়াজ ‘ক্রসড সোর্ড : পাকিস্তান, ইটস আর্মি অ্যান্ড দ্য ওয়ারস উইদিন’ বইতে লিখেছেন, ‘জিন্নাহ্র সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকতের আচরণ সম্পর্কে বলা যায়, যে কোনো ধরনের পরিকল্পনা জিন্নাহ্্র পরোক্ষ অনুমোদন ছাড়া প্রণয়ন অসম্ভব বলেই মনে হয়।’ সন্দেহ নেই, যদি হামলাকারীরা শ্রীনগর দখল করে নিত, তাহলে পাকিস্তানের স্কুল-পাঠ্যে প্রতিটি বইতে জিন্নাহ্কে ‘সামরিক প্রতিভা’ বলে জাহির করা হতো।

লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭-এর ২৮ অক্টোবর আয়ান স্টিফেনকে বলেছিলেন, ‘অ্যাবোটাবাদে জিন্নাহ্্... কাশ্মীরে জয়ের আশা করেছিলেন... তিনি হতাশ হয়েছেন।’ স্টিফেন পরে দ্য স্টেটসম্যান-এর সম্পাদক হয়েছিলেন। যেখানে সমস্যা মোচনে আলোচনার জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন, সেখানে জিন্নাহ্্ জিহাদের জন্য কেন ১৯৪৭-এর অক্টোবরকে বেছে নিলেন? ওভাবে যুদ্ধে নেমে পড়া যে কোনো যুক্তিতে, আন্তর্জাতিক আবহে কিংবা সাধারণ বুদ্ধিতে একটি অচিন্তনীয় পদক্ষেপ।

সদ্য জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের তখন ছিল অকার্যকর প্রশাসন, নগণ্য সম্পদ এবং একটি বৃহদায়তন উদ্বাস্তু সংকট। তবু জিন্নাহ্্ ও তার সহকারীদের মনে, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে শুধুই ছিল যুদ্ধচিন্তা।

জম্মু ও কাশ্মীরের পরিস্থিতি ছিল তখনো অনির্দিষ্ট। মহারাজা হরি সিংকে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের সঙ্গেই এই মর্মে চুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়েছিল যে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হবে। আবার ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই ১৯৪৭-এ ছিল ডোমিনিয়ান। সে কারণেই ব্রিটিশ নাগরিক লর্ড মাউন্টব্যাটেন হলেন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল (প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদার)। এর অর্থ এটাও যে, ব্রিটেনের একটা অংশীদারত্ব ছিল, অন্তত যত দিন মাউন্টব্যাটেন দিল্লিতে ছিলেন। ১৯৪৮-এর বসন্তে জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা শুরুর কথা ছিল। তবু জিন্নাহ্্ যুদ্ধের দিকে ধাবিত হলেন। কেন?

উত্তর তঞ্চকতা আর বিকৃত মতাদর্শের মধ্যে নিহিত।

১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানি নেতৃত্ব কল্পকাহিনী ছড়ায় যে, দীর্ঘ সংগ্রাম থেকে জš§ হয়েছে পাকিস্তানের। সম্ভবত এই অসত্যের প্রয়োজন ছিল, কারণ একটা মুখরোচক রটনা বলে চলেছিল যে, একটি গোপন চুক্তির অংশ হিসেবে জিন্নাহ্কে ব্রিটিশরা পাকিস্তান হস্তান্তর করেছিল।

আদতে যা ঘটেছে তা হলো, জিন্নাহ্ এবং মুসলিম লীগ কখনই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি। কোনো গণ-আন্দোলনের, এমনকি কোনো জিহাদের উদ্যোগও নেননি। মুসলিম লীগের কোনো নেতাকে জেলে যেতে দেখা যায়নি। এটা নির্দ্বিধায়ই বলা যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দীর্ঘ ছয় বছর ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করে জিন্নাহ্্ যে পণ্যটি উৎপাদন করলেন, সেটাই পাকিস্তান। ব্রিটিশরা তাদের অন্ধকার সময় ১৯৪০-৪১-এ মুসলিম সৈন্য দিয়ে বিশেষ করে পাঞ্জাব ও সীমান্ত এলাকায় সাহায্য করায় জিন্নাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞ। প্রায় ২৫ লাখ ভারতীয় নাগরিক যুদ্ধে যুক্ত হয়েছিল, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল মুসলমান। ব্রিটিশরা সংখ্যালঘু অধিকারের বিষয়ে ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়ে জিন্নাহ্কে পুরস্কৃত করে। আর জিন্নাহ্্ সেই ভেটোকে পরিণত করলেন পাকিস্তানে। ব্রিটিশরাজ জিন্নাহ্র বন্ধু ছিল, শত্র“ নয়।

একমাত্র জিহাদ যেটা, জিন্নাহ্্ সেটা ১৯৪৭-এর আগে হিন্দুদের বিরুদ্ধে শুরু করেন। ১৯৪৬-এ, মন্ত্রিপরিষদ মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর, ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট জিন্নাহ্ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর ডাক দিলেন, এবং মুসলিম লীগের ক্যাডার ও এর ন্যাশনাল গার্ড সেই প্রাণঘাতী সংগ্রামে নেমে পড়ল, যার উৎসকেন্দ্র ছিল কলকাতা। ইতিহাসে এটা ভয়াবহ ‘কলকাতা হত্যা’। ওই সময়কার নিষ্ঠুরতা ও রক্তপাত উভয় পক্ষের মধ্যে ফের গণহত্যাকে উসকে দেয়; এবং ঐক্যবদ্ধ ভারতের সমস্ত আশা মৃতদেহে পরিণত হয়।

বিভক্তির পর, লীগের ইতিহাস পুনর্বিবেচনার স্লোগান ওঠে- ‘লড়কে লিয়ে পাকিস্তান, লড়কে লেঙে কাশ্মীর’ (আমরা পাকিস্তান নিতে লড়াই করেছি, আমরা কাশ্মীর নিতে লড়াই করব)। এটি ছিল আহংকারিক শিরোনাম। এ ছাড়া এটি ছিল অদ্ভুত ধারণার বর্ণবাদী পৌরাণিক কাহিনী দ্বারা উৎসাহিত যে, হিন্দুরা যুদ্ধ করতে পারে না। ১৯৬৫ সালে আমরা দেখলাম, আইয়ুব খান এই অদ্ভুত ধারণা তৈরি করলেন তার সামরিক মতবাদের অংশ হিসেবে। প্রতারণার সবচেয়ে গুরুতর ধরন হচ্ছে আত্মপ্রতারণা। যারা এ লড়াই শুরু করেছিল, তারা এখনো বিভ্রমতার খপ্পরে পড়ে আছে, এমনকি যে যন্ত্রণা ও হতাশা সৃষ্টির কারণ তারা, এর সবই বাস্তব। নিষ্পাপ রক্ত স্রোতস্বিনী ট্র্যাজেডির মধ্যে প্রবাহিত।

১৯৬৫-তে, পাকিস্তান অতীব যতেœ ১৯৪৭-এর পুনরাবির্ভাব ঘটায়। এরপর আবার শঠতার আবহে বিরোধ শুরু হয়। প্রতারণার এ মঞ্চের আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন জিব্রালটার’।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে শুরু হয় সব আক্রমণ। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান এবং তার ঝামেলা বাধাতে পটু পররাষ্ট্রমন্ত্রী তরুণ জুলফিকার আলী ভুট্টো চীনের সঙ্গে ’৬২ সালে ভারতের মারাত্মক পরাজয় আগ্রহভরে অবলোকন করলেন। তারা দেখলেন পাকিস্তানের জন্য এটি একটি সুযোগ যে, এখন ভারতের শারীরিক ও মানসিক ক্ষত নিরাময় করার সময়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেননের সময়ে বিপর্যয়কর অবনতির পর ভারত পুনরায় বাহিনী গঠনে মনোনিবেশ করেছে। কিন্তু পুরোপুরি শক্তি সঞ্চয় করতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। বিপরীতে পাকিস্তান আর্মি দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে ১৯৪৭-এর পর থেকে। রাওয়ালপিন্ডির ১৬০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা এলাকা থেকে নিয়োগ পান অধিকাংশ কর্মকর্তা। এটি ছিল ব্রিটিশ নীতিরই ধারাবাহিকতা, যা ‘সামরিক জাতি’ নামের গোষ্ঠী থেকে সংগৃহীত সৈনিক বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।

১৯৬৪-তে যুদ্ধংদেহি ভুট্টোর মাধ্যমে আইয়ুব খান আদেশ দিলেন অতি গোপনীয় পরিকল্পনা শুরু করতে। এই পরিকল্পনার হাতে গোনা অংশীদারদের একজন ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আজিজ খান, জিওসি ১২ ডিভিশন মেজর জেনারেল আখতার হুসাইন মালিক, যিনি কাশ্মীরের একটি বড় সেনাবহরের দায়িত্বে ছিলেন, এবং দুই ব্রিগেডিয়ার ইরশাদ আহমদ খান, পরিচালক সামরিক গোয়েন্দা এবং গুল হাসান খান, পরিচালক সামরিক অপারেশন।

অপারেশন জিব্রালটার শুরু হয়েছিল ১৯৬৫ সালের ২৪ জুলাই। নিচু এলাকার জন্য সেনা রাখা হলো তিন হাজার, আর উঁচু এলাকার জন্য ৩০ হাজার। তাদের মিশন, ১৯৪৭-এর মতো, তারিক বিন জায়েদের ঢুকে পড়ার অভিযানসদৃশই। তবে স্পেনে নয়, সেবার ঢুকে পড়া হয়েছিল শ্রীনগরে।

ঘটনাগুলো যে ভারতীয় ভাষ্য অনুসারে বর্ণিত নয়, তার ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য আমি আবারও সুজা নওয়াজের বই থেকে উদ্ধৃত করছি : ‘ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে স্থানীয় জনবিক্ষোভ উসকে দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটানোর কাজে সহায়তা করার জন্য অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তান আর্মি অফিসারদের হাতে গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভিত্তিতে তৈরি হয় জিব্রালটার। এর সেনাদল বিভক্ত ছিল সহায়ক ইউনিটে, যেগুলোর নামকরণ করা হয়েছিল মুসলিম বীরদের নামে। যেমন- তারিক (বিন জায়েদ), (মুহাম্মদ) গজনবী, সালাউদ্দিন, (মুহাম্মদ বিন) কাশিম, খালিদ (বিন ওয়ালিদ)। একটি ফোর্সের নাম ছিল নুসরাত, অর্থাৎ ‘বিজয়’...। এদের কাজ ছিল যুদ্ধবিরতি রেখার পেছন থেকে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে নাশকতা।’

অনুপ্রবেশ, অন্তর্ঘাত, ভারতীয় সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর ওপর হামলা- সবই ছিল সর্বজনবিদিত।

প্রশিক্ষিত এসব সৈন্য ও অফিসার নিজেদের বেসামরিক ‘কাশ্মীরি’ নাগরিক বলে দাবি করবে এবং ৮ আগস্টের মধ্যে পীর দস্তগির সাহেবের দরগায় পৌঁছে তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে মিশে যাবে। পরদিন তারা ঢুকবে শ্রীনগরে এবং দখল করে নেবে বিমানবন্দর ও বেতার কেন্দ্র। এরপর গঠন করবে ‘রেভুল্যুশনারি কাউন্সিল’। এ কাউন্সিল করে পাকিস্তানের কাছে সাহায্য চাইবে। তখন পাকিস্তান নেবে তার দ্বিতীয় পদক্ষেপ- ‘অপারেশন গ্র্যান্ড স্ল্যাম’। অর্থাৎ যুদ্ধবিরতি রেখা থেকে চালানো হবে নিয়মিত হামলা। কাগজে-কলমে ছকটা ভালোই দেখায়। কিন্তু ধারাক্রমে জিব্রালটারকে ব্যঙ্গচিত্র ইতিহাসের শিশুই বেশি মনে হয়।

জিহাদিদের ‘জিব্রালটার ১৯৬৫’ চক্রান্ত আক্ষরিক অর্থেই মার খেল। তার বেশির ভাগই কাশ্মীরি ভাষায় কথা বলতে পারত না। এমনকি মামুলি তথ্যও তাদের দেওয়া হয়নি। ওজন ও পরিমাপের (সের ও মণ) ক্ষেত্রে ভারত যে আধুনিক পদ্ধতি চালু করেছে, তাও ছিল এদের অজানা। কেনাকাটা করতে দোকানে গেলে ওরা ডে পাকিস্তানি, তা ধরা পড়ে যেত। অবধারিতভাবে তাদের অনেকেই গ্রেফতার হলো।

জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়ে তাদের কিছু অফিসার মুক্ত বিহঙ্গের গানের মতো সব কেচ্ছা বলে দিতে লাগল। জিব্রালটার বিপর্যয়ে ফিল্ড মার্শাল দমলেন না; ২৯ আগস্ট তিনি তার সেনাবাহিনীকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। নির্বোধের মতো বলতে থাকলেন, ‘সঠিক জায়গায়, সঠিক সময়ে কয়েকটি আঘাত হানলে হিন্দুদের নৈতিক মনোবল টিকতে পারবে না।’ ভারতের মনোবল কতটা দৃঢ় তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন।

পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণের আখনুরের দিকে এগিয়ে গিয়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। যুদ্ধটা কেমন হয়েছিল তা সবারই জানা; আমাদের আটকে রাখার দরকারই তাদের হলো না। বিজয়ের পরিবর্তে পাকিস্তান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হাজী পীরসহ গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথগুলো হারায়। আসাল উত্তারের মতো গুরুতর যুদ্ধে পরাস্ত হয়। যুদ্ধ শেষ হয় তাশখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে। ওই সময় সবার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তাশখন্দ চুরমার করে দেয় আইয়ুব খানের বিশ্বাসযোগ্যতা। ক্ষমতা ছাড়তে তাকে বাধ্য করা হয়।

ভারত যদি হাজী পীর গিরিপথটা দখল করে রাখত তাহলে ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানি সেনাদের কারগিলের মধ্য দিয়ে কাশ্মীর উপত্যকায় আসাটা কঠিন হতো। পাকিস্তান একই ধরনের গেম প্ল্যানের পুনরাবৃত্তি করেছিল কারগিলে। গোড়ার দিকে পাকিস্তান তাদের সৈন্যদের এতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে। পরে তাদের সৈন্যরা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে কারগিলে অসাধারণ বিজয় এখনো মানুষের মনে গেঁথে আছে। যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর বাজপেয়ি শান্তির জন্য তার সর্বোচ্চটা করেছিলেন। তিনি লাহোর যান এবং পাকিস্তানকে অঙ্গীকারবদ্ধ করেন যে, সব বিরোধের নিষ্পত্তি তারা চায়। কিন্তু ২০০১ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে হামলা হয়, আবার ফিরে আসে সন্ত্রাসবাদ, ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে ভয়াবহ হামলায় হত্যার ঘটনা ঘটে এবং এই সেদিন ঘটল পুলওয়ামায়।

ভারতীয়দের একটাই প্রশ্ন- এই ধারাবাহিকতা, এই জোরজবরদস্তি, এই সন্ত্রাসবাদের শেষ কোথায়?

পাকিস্তান যত দিন না তার আচরণে পরিবর্তন আনবে অন্তত তত দিন এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। আত্মস্বীকৃত সন্ত্রাসী সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পাকিস্তানকে বলেছে ভারত, যারা পাকিস্তান ভূখে র নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। জবাবে আমরা দেখলাম পাকিস্তানের চাতুরীর খেল। ‘বাণিজ্যে সর্বোচ্চ সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ’-এর যে মর্যাদা তা ভারত বাতিল করেনি। সম্প্রতি মোদি সরকার ওই সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়। এ ছাড়া দিল্লি সব সময়ই সিন্ধু পানি চুক্তিতে দেওয়া তার প্রতিশ্র“তি রক্ষা করে চলেছে।

নাশকতার পেছনে হাত থাকার অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করতে এর আগেও আমরা শুনেছি। যেমন : ১৯৪৭ সালের হামলাকারীদের সম্পর্কে জিন্নাহ্্ এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতারা ‘কিছুই জানতেন না’; অপারেশন জিব্রালটার ঘটনা না জানার ভান করতেন আইয়ুব খান; জেনারেল জিয়াউল হক জোর দিয়ে বলতেন যে খালিস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উসকে দিতে কিছুই করেননি তিনি। অথচ ওরা লাহোরে আশ্রয়, তহবিল ও অস্ত্র পেয়েছিল। নওয়াজ শরিফ দাবি করতেন, তার সেনাপতিরা তাকে ধাপ্পা দিয়ে কারগিল ঘটনা ঘটিয়েছে। ২০০৮-এ মুম্বাইয়ে যে বর্বর হামলা চালানো হয়েছিল, এর একজন পরিকল্পনাকারী হয়েও পারভেজ মোশাররফ নিজেকে ‘নেকদিল আদমি’ বলে জাহির করেন। আজ ইমরান খানও সেই একই সুরে গাইছেন। বলছেন, ‘অকাট্য প্রমাণ’ দেখাও। যারা জেনে-বুঝে অন্ধ বা বধির তারা কীভাবে দেখতে বা শুনতে পাবেন! বিশ্বাসের পথে যাওয়ার জন্য তারা বেছে নিয়েছে প্রতারণা।

পুলওয়ামা নিয়ে যেমন সামরিক প্রতিক্রিয়া আছে, তেমনি আছে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। আমরা প্রথমে সামরিক বিষয়ের দিকে যেতে পারি; যেমন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তারা জানেন কী করতে হবে এবং কখন করতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে দেখলে এর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, বিষয়টির প্রতি সেভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। এর কারণ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক ধরনের বিভাজন বিরাজ করছে। এর সূচনা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যেদিন কাশ্মীর ইস্যুকে জাতিসংঘে নিয়ে যান সেদিন। সময় এসেছে এই বিভাজনের সমাপ্তি টানার।

জম্মু ও কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বিরোধিতা করছে পাকিস্তান। আমরা পাকিস্তানের মনোভাব পাল্টাতে পারব না। কিন্তু আমাদের নিজেদেরটা তো পারি। জোর দিয়ে বলার সময় এসেছে, ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তি একটা সম্পন্ন হওয়া অধ্যায়। আমাদের অবশ্যই বিষয়টা আলোচ্যসূচিতে রাখা বন্ধ করতে হবে। ইসলামাবাদের সঙ্গে ‘দখলকৃত কাশ্মীর’ থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যহার নিয়ে আলোচনা ছাড়া অন্য কোনো আলোচনা নয়। ভারতীয় সংসদে অনুমোদিত একটা প্রস্তাবেও এটি প্রতিফলিত। যৌক্তিক পরিণতির দিক নিয়ে যাইনি।

সেই উপসংহারের একটি চূড়ান্ত পদক্ষেপ প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের পূর্ণ একত্রীকরণ। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে বোঝার ত্র“টি রয়েছে। প্রদেশকে যে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা অনুধাবনে আমাদের মৌলিক ভ্রান্তি ঘটছে।। ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরুর জন্য, চিরকাল ওটা ধরে রাখার জন্য নয়। সম্ভবত ১৯৪৭ সালে এটা জরুরি ছিল এবং পরবর্তী কয়েক সময়কার প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতির জন্যও। কিন্তু কালের বড় এক বিবর্তন হয়েছে। এখন আমাদের জাতিগত ঐক্য সবার আগে।

প্রত্যেক কাশ্মীরিই ভারতীয় নাগরিক। এমন কিছু এখানে নেই যাতে কাউকে ‘বিশেষ’ ভারতীয় কিংবা ‘শর্তসাপেক্ষ’ নাগরিক গণ্য করতে হবে। গোটা ভারতের নাগরিকদের সমান অধিকার বলবৎ থাকতে কোনো একটি প্রদেশের বাসিন্দাদের ‘বিশেষ মর্যাদা’ কেন দিতে হবে?

এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৭ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে, যখন গোপালাস্বামী আয়াঙ্গার সংবিধানের ৩০৬(এ) অনুচ্ছেদ সংসদে তুলেছিলেন। এটি ৩৭০ অনুচ্ছেদে পরিণত হলো। হাসরাত মোহানি নামে এক সংসদ সদস্য প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কেন এই বৈষম্য? অনুগ্রহ করে বলুন।’ তিনি আশা করেছিলেন, রাজাশাসিত অন্যান্য অঞ্চলের মতোই জম্মু ও কাশ্মীরও ভারতের সঙ্গে একীভূত হবে। সভ্য ও কা-জ্ঞানসম্পন্ন সরকারের অভিধানে ‘প্রতিশোধ’ শব্দটি থাকা উচিত নয়। থাকা উচিত ন্যায়বিচার। দুটি বিষয়ের একটা অভিন্নতা রয়েছে। ক্জ দুটি ভালোভাবে করা যায় ঠান্ডা মাথায়।

সর্বশেষ খবর