বুধবার, ৬ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভোট দেওয়ার নিশ্চয়তা চায় শিক্ষার্থীরা

একতরফা কোনো কিছু চায় না কেউই

আকতারুজ্জামান ও নাসিমুল হুদা

ভোট দেওয়ার নিশ্চয়তা চায় শিক্ষার্থীরা

আর মাত্র পাঁচ দিন পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচন। নির্বাচন ঘিরে ভোটারদের উত্তেজনার কমতি নেই। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া নিয়ে নানা শঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। ভোট দিতে পারবেন কি না এ নিয়ে অনেকের মধ্যেই রয়েছে উৎকণ্ঠা। গায়েবি ভোট হয়ে যায় কি না এ নিয়েও শঙ্কা রয়েছে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে। শিক্ষার্থীরা এ নির্বাচনে নিজেদের ভোট নিজেরা দেওয়ার নিশ্চয়তা চান। সম্প্রতি জাতীয় পর্যায়ের নানা নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে, কোনোভাবেই এর প্রতিফলন দেখতে আগ্রহী নন কেউ। নির্বাচন সামনে রেখে ভোটাধিকার নিশ্চিত করাকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের প্রধান দাবি। এ ছাড়া ভোটের দিন কোনো পক্ষ বা শক্তি যেন নির্বাচন প্রভাবিত করতে না পারে এমন দাবি করেছেন প্রার্থীরা। সাধারণ শিক্ষার্থী ও ভোটারদের মতে, ডাকসুর সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ নির্বাচিত নেতারা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই কাজ করবেন না, তারা দেশের ক্রান্তিকালেও সারা দেশের শিক্ষার্থীদের দিকনির্দেশনা দেবেন। তাই তাদের হতে হবে সর্বজনীন। নিজেদের স্বার্থকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে এই নেতাদের মধ্যে। সরেজমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন, বিভিন্ন একাডেমিক ভবন, হল, টিএসসি ঘুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এমন মন্তব্য পাওয়া গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগে অধ্যয়নরত হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের শিক্ষার্থী মুক্তাদির মেহেদী বলেন, অনেক বছর আগে যখন ডাকসু নির্বাচন হয়েছে, তখনকার ভোটের সংস্কৃতি আর এখনকার ভোট নিয়ে ধারণা এক নয়। ভোটের পরিস্থিতিও এক নয়। এখন নির্বাচন নিয়ে একটা শঙ্কার মধ্যে থাকেন ভোটাররা। সব ভোটার ভোট দিতে পারবেন কি না এ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। মেহেদীর মতে, ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের বাইরে থাকেন। তাই হলের বাইরে রয়েছে বড় ভোটব্যাংক। কিন্তু ভোটের সময় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত নির্ধারিত রয়েছে। এই সময়ে বাইরে থেকে এসে নিবন্ধিত সব ভোটার ভোট দিতে পারবেন কি না এ নিয়েও রয়েছে সংশয়। ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানোর দাবি জানান মুক্তাদির মেহেদী। প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণা অব্যাহত রাখলেও ভোটের দিনের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কিত বিজয়৭১ হলের শিক্ষার্থী শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগে অধ্যয়নরত মো. রায়হান হোসেন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশ রয়েছে ডাকসু ভোট নিয়ে। কিন্তু ভোটের দিনে কেমন পরিবেশ থাকবে সেটিই কথা। আমরা চাই এমন উৎসবমুখর পরিবেশেই ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। আমরা চাই ভোটাররা যেন নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে পারে। অন্য কেউ যেন আমাদের ভোটাধিকার কেড়ে না নেয়। কোনো পক্ষ বা অপশক্তি যেন অপছন্দের কোনো প্রার্থীকে ভোট দিতে চাপ প্রয়োগ না করে।’ রায়হান হোসেন বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি দেশে কর্তৃত্ববাদী নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এমন পরিস্থিতি আমরা ডাকসুতে দেখতে চাই না। আমরা এমন নির্বাচন চাই, যেখানে নিজেদের ভোট দেওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে কথা হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র উদিত প্রান্তের সঙ্গে। প্রান্ত মনে করেন, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন। তাই যারা শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলবেন, দেশের স্বার্থ নিয়ে কথা বলবেন, তাদেরই ভোট দেবেন ছাত্র-ছাত্রীরা। তিনি বলেন, ‘যাতে ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় এ জন্য ঢাবি শিক্ষার্থীরা বেশ সচেতন।’ ভোট দেওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শঙ্কা কাজ করলেও প্রচারণায় কোনো শঙ্কা নেই বলে মত দেন আইন বিভাগে পড়া লামিয়া ফারজিন ইমা। তিনি বলেন, ‘সবাই প্রচারণা চালাতে পারছেন। ভোটের ক্ষেত্রে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে ফাঁকা বুলি নয়, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সত্যি কাজ করতে চান, তাদেরই ভোট দেব।’ সুফিয়া কামাল হলের তাসনিব মৌলি বলেন, ‘প্রার্থীদের ইশতেহার বড় বিষয় নয়। কোন প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন সেটিও বিবেচ্য নয়। আমরা প্রার্থী দেখেই ভোট দেব। কোনো চেতনাকে কোনো পক্ষ যেন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যাপারে সচেতন রয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা।’ এদিকে ভোট গ্রহণের দিনের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতীয় ছাত্রলীগের (জাসদ) সভাপতি আহসান হাবিব শামীম। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ নানা শঙ্কার তৈরি করছে। ভোটের দিন প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা ভোটবাক্সের নিরাপত্তা কতখানি দিতে পারবেন তা নিয়ে সন্দিহান আমরা। এ ছাড়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি সমগ্র ডাকসু নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রশাসনের সহযোগিতার অভাবেই এসব পদ থেকে অনেক প্রার্থী সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন বলেও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তিনি। ছাত্রদলের সূর্যসেন হলের সহ-সভাপতি প্রার্থী এরশাদ মাহমুদ বলেন, ‘ক্যাম্পাসে প্রচার-প্রচারণায় কোনো বাধা নেই। তবে হলকেন্দ্রিক প্রচারণায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ব্যতীত অন্যরা বাধার মুখে পড়ছেন। ছাত্রদলের কোনো নেতা-কর্মীকে এখন পর্যন্ত হলে উঠতে দেওয়া হয়নি। আমরা সব আইনগত পদ্ধতি মেনে আবেদন করার পরও কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো সহযোগিতা করছে না। হলের অভ্যন্তরে প্রচারণা চালাতে মৌখিক অনুমোদন পাওয়া গেলেও বাস্তবে এর মিল নেই।’ স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী এআরএম আসিফুর রহমান বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার অনেক জায়গা রয়েছে। ভোটের সময় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে সব ভোটার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন না। আসিফ বলেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরে দাঁড়াতে চাপ দেওয়া হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। এ ছাড়া আবাসিক হলে ভোটের প্রস্তুতি থাকায় অনাবাসিকদের মধ্যে ভোটে অনাগ্রহ লক্ষ করা গেছে। তাদের আস্থায় নিতে বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ হলগুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে দখলদারি কায়েম করে রেখেছে। এ দখলদারি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে পরিস্থিতি দেখেছি, তা ডাকসুতে দেখতে চাই না।’ এ স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেন, ‘ডাকসুতে কোনো কারচুপি হতে দেব না। কেউ কারচুপির চেষ্টা করলে সাধারণ ছাত্ররা তা প্রতিহত করবে।’ তবে পরিবেশ নিয়ে অভিযোগের সুযোগ নেই বলে মনে করেন ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, ‘শতভাগ সৌহার্দ্য নিয়ে সব ছাত্র সংগঠন প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রচারণার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বাধা বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টির কোনো অভিযোগও নেই। সব সংগঠন সহাবস্থানের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।’

জমজমাট প্রচারণা ও সম্পূরক ভোটার তালিকা প্রকাশ : গতকাল সম্পূরক ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে ভোট গ্রহণ ছাড়া নির্বাচনী তফসিলে ঘোষিত সব কাজ সম্পন্ন করল প্রশাসন। নির্বাচন সামনে রেখে গতকালও প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন কেন্দ্রীয় ও হল সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। সকাল থেকে নির্বাচনী প্রচারণায় নামে ছাত্রলীগ। সংগঠনটির সহ-সভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) গোলাম রাব্বানী ও সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী সাদ্দাম হোসেন মধুর ক্যান্টিন থেকে প্রচারণায় নামেন। তারা সংগঠনটির প্যানেল নিয়ে কলা ভবন, কার্জন হল, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ও টিএসসি এলাকায় প্রচারণায় অংশ নেন। এ ছাড়া হল সংসদসমূহে ছাত্রলীগের প্রার্থীরা প্রচারণায় নেমেছেন। ছাত্রদলের প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও জিএস পদপ্রার্থী আনিছুর রহমান অনিকের নেতৃত্বে কলা ভবন, কার্জন হল ও মল চত্বর এলাকায় প্রচারণা চালানো হয়। বিকালে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেও প্রচারণা চালান তারা। প্রচারণার ক্ষেত্রে আবাসন সংকট, ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে যান চলাচল ইত্যাদি বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। ভিপি পদপ্রার্থী নুরুল হক নুর ও জিএস পদপ্রার্থী রাশেদ খানের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ প্যানেলের প্রচারণা সকাল থেকে শুরু হয়। সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউট এবং লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি কলা ভবন ও কার্জন হল এলাকায় ঘুরে ঘুরে নিয়মিত প্রচারণা চালান তারা। গতকাল জগন্নাথ হলে প্রচারণা চালান এই প্যানেলের প্রার্থীরা। বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর দুই জোট প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য যৌথ প্যানেলে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দীসহ অন্য প্রার্থীরা কলা ভবন, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ এবং অপরাজেয় বাংলা ও কার্জন হল এলাকায় প্রচারণা চালান। সকালে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে একটি শোভাযাত্রা বের করেন তারা। শোভাযাত্রাটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে। সাংবাদিকতা ছেড়ে স্বতন্ত্রভাবে ডাকসুর জিএস পদপ্রার্থী এম আর এম আসিফুর রহমানও সকাল থেকে অপরাজেয় বাংলা, বটতলা, মধুর ক্যান্টিন, ডাকসু ভবন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে প্রচারণা চালান।

আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ বাম জোটের বিরুদ্ধে : ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণায় আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ এসেছে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর যৌথ প্যানেলের বিরুদ্ধে। গতকাল দুপুরে ছাত্রলীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান সনজিত চন্দ্র দাস ডাকসুর রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান বরাবর এ অভিযোগ দায়ের করেন। গতকাল সকালে বামপন্থি প্যানেলের সহ-সভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী লিটন নন্দীর নেতৃত্বে এক ধরনের ড্রামসদৃশ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল করা হয় এবং প্যানেলের প্রচারণা চালানো হয়।

ছাত্রসমাজের প্যানেল ঘোষণা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়   কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অংশ নিতে দুই সদস্যের দলীয় আংশিক প্যানেল ঘোষণা করেছে এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজ। নকিবুল হাসান নিলয়কে সহসভাপতি (ভিপি) ও মামুন ফকিরকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) করে এই প্যানেল গঠন করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক মোড়ল জিয়াউর রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলীয় প্যানেল ঘোষণা করে ছাত্রসমাজ।

সর্বশেষ খবর