শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাড়ছে বেকারত্ব, বাড়ছে দক্ষ কর্মীর অভাব

উভয় সংকটে চাকরির বাজার

জুলকার নাইন

একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার ছয়টি পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের প্রথম দিনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীদের জন্য নির্ধারিত এসব পদের বিপরীতে অনলাইন ও অফলাইনে আবেদনপত্র জমা পড়েছে প্রায় ৮২ হাজার ৬৫২টি। বিজ্ঞাপনদাতা কর্তৃপক্ষ এখন বিপাকে পড়েছেন কীভাবে এই বিপুল আবেদনকারীর মূল্যায়ন করবেন। কর্তৃপক্ষ এখন বিকল্প হিসেবে পরিচিতদের মধ্য থেকে যোগ্যদের নিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছেন। অন্যদিকে, একটি বহুজাতিক ব্যাংকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে চাকরিরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসনের বিবিএ ডিগ্রিধারী জায়েদ চাইছেন চাকরি পরিবর্তন করতে। তিনিও ওই বিজ্ঞাপনী সংস্থায় আবেদন করলেও এখনো ইন্টারভিউয়ের ডাক পাননি। বললেন, গত দুই মাসে প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত ১৬৪টি প্রতিষ্ঠানে আবেদন জমা দিয়ে দুটিতে মাত্র ডাক পেয়েছিলাম।

আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগ থেকে স্মাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া জামান সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই। পরীক্ষা দিচ্ছেন অনার্সের পর থেকেই। এখন মাস্টার্স শেষে প্রায় দেড় বছর পুরোপুরি চাকরি প্রার্থী। জামানের ভাষায়, ‘আসলে সরকারি এসব চাকরি পেতে হলে মেধার পাশাপাশি ওপরের লেভেলে লোক বা টাকা থাকা লাগে। সবই দেখছি, কিন্তু কষ্টপাই যখন বাড়ি থেকে ফোন করে বাবা মলিন কণ্ঠে জানতে চান চাকরি হয়েছে কিনা।’ পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ১ কোটি ৪৫ লাখ লোক কাজ পেয়েছেন। এখনো প্রায় ১ কোটি লোক বেকার। তার ওপর প্রতি বছর ২০-২২ লাখ মানুষ কাজের খোঁজে শ্রমবাজারে ঢুকছেন। প্রতি বছর যে পরিমাণ তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে তার তুলনায় চাকরির সংখ্যা বাড়ছে নগণ্য পরিমাণে। ব্রিটিশ সাময়ীকি ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকধারী তরুণ-তরুণই বেকার। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণীর মধ্যে ৪৭ জন বেকার। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, বেকারদের মধ্যে চিকিৎসক-প্রকৌশলীদের হার ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। নারী চিকিৎসক-প্রকৌশলীদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ৩১ শতাংশ। এর পরই আছেন উচ্চমাধ্যমিক ডিগ্রিধারীরা। তাদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০টি সর্বাধিক বেকারত্বের দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্য মতে, দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ৯৫ সালে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী বেকার যুবকের সংখ্যা ছিল ২৯ লাখ। কিন্তু ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে তা প্রায় পাঁচগুণ বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি ৩২ লাখে। অবশ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সারা দেশে ৬ কোটি ৩৫ লাখ কর্মক্ষম (১৫-৬৫ বছর বয়সী) মানুষ ছিলেন। ২০১৭ সালে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষের কাজ ছিল। বাকি ২৭ লাখ ছিলেন বেকার। তবে সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সাদ’ত  হুসাইন মনে করেন,  চাকরি ও যোগ্য চাকরিপ্রার্থী দুটোরই সংকট আছে। দীর্ঘ সময় সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা ড. সাদ’ত হুসাইন সম্প্রতি এ প্রতিবেদককে বলেন, কিছু পদের জন্য ৭০ থেকে ৮০ হাজার আবেদনপত্র জমা পড়লেও কোনো কোনো পদের জন্য মাত্র কয়েকটি আবেদপত্র জমা পড়ার নজিরও আছে। আবার বিসিএসের বেশকিছু নিয়োগের ভাইভাতেই ভালো রেজাল্টধারী শিক্ষার্থীরাও যথাযথ যোগ্যতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হতে দেখা গেছে।

চাকরিদাতারা পায় না দক্ষ ও যোগ্য কর্মী : বেসরকারি ও প্রাইভেট কোম্পানির চাকরির বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, চাকরি দেওয়ার মতো দক্ষ কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। দিন দিন দক্ষ কর্মীর এ সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে বলেও অভিযোগ চাকরিদাতাদের। এ কারণেই বাংলাদেশের চাকরির বাজারে বিদেশিদের আধিপত্য দেখছেন তারা। সব মিলিয়ে এক ধরনের উভয় সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশের চাকরির বাজার। যথাযথ কারিকুলাম না থাকা সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলো এক ধরনের শিক্ষিত বেকার তৈরির কারাখানার ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমেদ। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলোর ৯০ ভাগই সাধারণ শিক্ষায় উত্তীর্ণ। এই সাধারণ শিক্ষায় উত্তীর্ণদের প্রয়োজনীয়তা বেসরকারি খাতে মাত্র ৩০ ভাগ। অথচ বেসরকারি খাতগুলোতে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ও শ্রমিক শ্রেণির জনবল প্রয়োজন হয় ৭০ ভাগ। পুরনো পদ্ধতি (কারিকুলাম) না পাল্টালে বেকার পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।

সরকারের প্রতিশ্রুতি, আছে  বড় চ্যালেঞ্জ : নতুন মেয়াদে ক্ষমতায় আসা বর্তমান সরকার আগামী পাঁচ বছরে দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

একাদশ সংসদের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, ২০২৩ সালের মধ্যে দেড় কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চশিক্ষিত তরুণদের তথ্যসংবলিত একটি সমন্বিত তথ্য-উপাত্ত ভা ার তৈরি করা হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রয়োজন এবং তরুণদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির জন্য আবেদনের আহ্বান জানাতে পারবে। এ ছাড়া দক্ষতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দুটি নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। প্রতিশ্রুতি অনুসারে, ‘কর্মঠ প্রকল্প’-এর অধীনে স্বল্পশিক্ষিত, স্বল্প দক্ষ, অদক্ষ তরুণদের শ্রমঘন, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উপযোগী জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ‘সুদক্ষ প্রকল্প’-এর অধীনে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা দূর করা হবে।

উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুসারে প্রতি বছর গড়ে ৩০ লাখ লোককে কাজ দিতে হবে। অর্থাৎ এখনকার চেয়ে চারগুণের বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য সরকারকে সে ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এগুলো হলো শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত কাজ সৃষ্টি করা, সেই কাজের উপযোগী মানবসম্পদ তৈরি করা এবং বাজারমুখী শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো ইত্যাদি।

সর্বশেষ খবর