শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

‘অনুভূতি’র আওয়ামী লীগ এখন সুবিধাবাদীদের অভয়াশ্রম

পীর হাবিবুর রহমান

‘অনুভূতি’র আওয়ামী লীগ এখন সুবিধাবাদীদের অভয়াশ্রম

আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে দলে প্রয়াত সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সহজ সরল ভাষায় হৃদয় দিয়ে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা নেতা-কর্মীই নয় সবার অন্তর স্পর্শ করেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম। জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত জড়িয়ে আছে দলটিতে। আছে জাতীয় চার নেতাসহ লাখো নেতা-কর্মীর রক্ত’।

আওয়ামী লীগ এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গৌরবের ইতিহাস বহন করা একটি রাজনৈতিক দল। দলের জন্মের সঙ্গে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, টাঙ্গাইলের শামসুল হকের নাম জড়িয়ে আছে। সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার অবদান রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের নানা ঘাত প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে অন্ধকার দুঃসময়ে অতিক্রম করে দলটি বিকশিত ও জনপ্রিয় দলেই পরিণত হয়নি একটি গণমুখী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবারের আবরণে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তৃণমূল পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই দেশে স্বাধিকার স্বাধীনতার সাফাল্যে গৌরব অর্জন করে গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে গণরায় নিয়ে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুতই করা হয়নি হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে দেশান্তরী ও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে।

সেই অন্ধকার সময়ে অমিত সাহস নিয়ে মহান মুজিবের আদর্শে নেতা-কর্মীরা বৈরী পরিস্থিতির মুখে আবারও সংগঠিত হয়েছেন। একাশি সালের ইডেন কাউন্সিলে দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরে গণতন্ত্রের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটে দলকে আবার শক্তিশালী জনপ্রিয় ও তৃণমূল বিস্তৃতই করেননি চারবারের মতো ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন। তার রাজনৈতিক জীবনও ছিল কণ্টকাকীর্ণ ঘাত প্রতিঘাত আর নানামুখী চ্যালেঞ্জে ভরা। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে জাতীয় রাজনীতিই নয় উপমহাদেশের গি  ছাড়িয়ে বিশ্ববরেণ্য নেতৃত্বের পাশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতায়। শেখ হাসিনার সঙ্গে মরহুম আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, মরহুম জিল্লুর রহমান, মরহুম আবদুল জলিল ও অকাল প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ কাউন্সিলে ওবায়দুল কাদের দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

ষাটের শেষে অগ্নিঝরা উত্তাল দিনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে ওবায়দুল কাদের নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই নেতৃত্বের জায়গা অর্জন করতে গিয়ে দল ও নেতৃত্বের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। পঁচাত্তরের পরে কারা নির্যাতন ভোগকালে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে বিদায় নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে কিছুকাল সাংবাদিকতাও করেন। ছাত্রলীগের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। একদিকে শেখ হাসিনা সরকারের যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী অন্যদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একজন সংগঠক হিসেবে দলের জন্য যেমন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তেমনি সরকারের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের বিশেষ করে যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার অর্পিত দায়িত্ব পালনেও ক্লান্ত হননি।

রবিবার ভোররাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে তার শারীরিক অবস্থা সংকটজনক অবস্থায় ছিল। জীবনমৃত্যুর মাঝখান থেকে দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর আবেগঘন অনুভূতি ও দোয়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ও মহান আল্লাহর রহমতে আমাদের দেশের চিকিৎসকরা তার অবস্থা স্থিতিশীল করে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তার চিকিৎসা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিদিন জানানো হচ্ছে তার শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। দেশের মানুষের দোয়া রয়েছে তার জন্য। উদ্বিগ্ন দেশবাসী প্রার্থনা করছেন তিনি আবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন তার কাজের জায়গায়। সরকার ও দলে সমান তালে ভূমিকা রাখবেন। নিয়তিতে সৃষ্টিকর্তা কী রেখেছেন তা মানুষের অজানা।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের সভানেত্রী যখন দেশের বাইরে যান তখন তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্যদের মধ্য থেকে যে কোনো একজনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। অতীতে আমরা এমনটি দেখেছি। এমনকি ওয়ান-ইলেভেনেও গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্তে মরহুম জিল্লুর রহমানকে তিনি ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। একই ভাবে দলের সাধারণ সম্পাদক শারীরিক অসুস্থতার কারণে বা দেশের বাইরে থাকায় দলের দায়িত্ব পালন করতে না পারলে কিংবা অনুপস্থিত থাকলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদের মধ্য থেকে যিনি শীর্ষে থাকেন তিনি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করবেন বলে উল্লেখ আছে। সেই ভাবে অতীতেও এটি কার্যকর হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনে দলের সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিল ও প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কারাবন্দী হলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন মরহুম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আর আশরাফুল ইসলাম লন্ডন চলে গেলে সর্বশেষ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুকুল বোস হয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। গঠনতান্ত্রিক সেই বিধিবিধান এখনো বহাল আছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি ওবায়দুল কাদের এখন সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শনিবার রাত পর্যন্ত তিনি দলের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করেছেন। আকস্মিক অসুস্থতা ও চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ায় দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। একজন ভদ্র বিনয়ী মাহবুব-উল আলম হানিফ দলের একটি বেদনাময় মুহূর্তে গঠনতান্ত্রিকভাবে এই দায়িত্ব পেয়েছেন। এটা তার নিজের জন্য বাড়তি কোনো সুখকর প্রাপ্তি নয়।

সমাজ সংসার রাজনীতি প্রশাসন কোনো কিছুই কারও অনুপস্থিতিতে থেমে থাকে না। তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু গভীর বেদনার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতি উৎসাহীরা চোখের চশম লাজলজ্জা সব ভুলে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় মাহবুব-উল আলম হানিফকে অভিনন্দন জানিয়েই যাচ্ছেন। এটা ওবায়দুল কাদেরের রাজনৈতিক সহকর্মী হানিফের জন্য যেমন বিব্রতকর তেমনি রাজনীতির শিষ্টাচার ও শালীনতার প্রশ্নে চরম অশালীন ও দৃষ্টিকটু। ওবায়দুল কাদের যদি আগামী কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক থেকে বিদায় নেন আর মাহবুব-উল আলম হানিফ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তখন আনন্দের সঙ্গে তাকে অভিনন্দন জানালে সেটি হবে শালীন ও শোভনীয়। ‘অনুভূতি’ নামের আওয়ামী লীগ আজ হৃদয়হীন সুবিধাবাদীদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। তাই তারা কোথায় আনন্দ করতে হয় আর কোথায় বেদনার অশ্রু বা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয় তার পার্থক্য ভুলে গেছে।

বিগত দশ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে সুযোগ সন্ধানী এসব আশ্রিতরা চাটুকারিতা মোসাহেবি ও সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া কিছু বোঝে না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছিলেন মূল বা ত্যাগী আওয়ামী লীগাররা অভিমানী হয় বেইমানি করে না। আর এই সুবিধাভোগী নানা শ্রেণি-পেশার যে নব্য আওয়ামী লীগারে ঐতিহ্যবাহী অনুভূতি প্রবণ দলটিতে গত দশ বছরে ভরে গেছে তারা কেবল নিজেদের লাভ-লোকসানের পাল্লাই বোঝে। সৈয়দ আশরাফের অনুভূতি বোঝে না। আবেগ অনুভূতিহীন স্বার্থান্ধ সুবিধাবাদী বর্ণচোরারা যখন যারা ক্ষমতায় তাদের পায়ের কাছে নানা বেশে দাসের মতো বসে থাকে।

পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজ গোটা দেশ যেন আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে এই নষ্টরা ওখানেই ভিড় করেছিল। আর আওয়ামী লীগের অনুভূতিপ্রবণ নেতা-কর্মীরা শেখ হাসিনাসহ গ্রেনেড হামলার শিকার হয়েছিলেন। কারাদ , রিমান্ড ও পুলিশি নির্যাতন ভোগ করে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছিলেন। দলের সেই দুঃসময়ে এসব অনুভূতিহীন মতলববাজদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওবায়দুল কাদের হাসপাতালের শয্যায় শায়িত হতে না হতেই গঠনতন্ত্রের সাধারণ বিধান অনুযায়ী মাহবুব-উল আলম হানিফ স্বাভাবিক নিয়মে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পেতে না পেতেই যারা অভিনন্দনে সোশ্যাল মিডিয়া ভাসিয়ে সবার বিরক্তির উদ্রেক সৃষ্টি করছেন দলের দুঃসময় এলে এদের যে খুঁজে পাওয়া যাবে না সেটি দলের সব স্তরের পোড় খাওয়া নেতা-কর্মীদের উপলব্ধি করার সময় এখন। নাটোর থেকে একজন মাঠের নেতা যাদেরকে হাইব্রিড বলেছিলেন, কেন্দ্রের নেতারা যাদের বসন্তের কোকিল বা কাউয়া বলে বিদ্রƒপ করেছিলেন তাদের এখন দূরে সরাবার সময়। না হয় নকলের ভিড়ে আসল হারিয়ে গেলে দলকে চড়া মূল্যই দিতে হবে।

সর্বশেষ খবর