বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

ক্ষোভ হামলা বিকালে কোলাকুলি

ভিপি নুরকে ছাত্রলীগের প্রথমে প্রত্যাখ্যান বিক্ষোভ পরে উৎসবমুখর পরিবেশে বরণ, কর্মসূচি প্রত্যাহার

জুলকার নাইন ও নাসিমুল হুদা

ক্ষোভ হামলা বিকালে কোলাকুলি

ভিপি পদের ঘোষণা বাতিলের দাবিতে গতকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির বাসভবন ঘেরাও করে ছাত্রলীগ, টায়ার জ্বালিয়ে ক্ষোভ, বিকালে কোলাকুলি দুই ছাত্রনেতার -বাংলাদেশ প্রতিদিন

তখন রাত সাড়ে ৩টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান ডাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণা শুরু করেন। প্রথমেই তিনি ঘোষণা করেন ভিপি পদের ফল। এ পদে নির্বাচিত হিসেবে নুরুল হক নুরের নাম ঘোষণা করতেই বিক্ষোভ শুরু করেন ছাত্রলীগের উপস্থিত নেতা-কর্মীরা। নামটি শুনেই ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ‘শেইম’ ‘শেইম’ বলে দুয়োধ্বনি দিতে থাকেন। মিনিট পাঁচেক ধরে তারা বিক্ষোভ দেখান। উত্তাপ  কিছুটা কমে এলে ডাকসু নির্বাচনে বাকি পদে বিজয়ী প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন উপাচার্য। বিজয়ীদের মধ্যে যখন নিজেদের কোনো প্রার্থীর নাম আসছিল, তখন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হাততালি দিয়ে ফলকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। কিন্তু পুরো ফল ঘোষণা শেষ হলে তারা ফের শুরু করেন বিক্ষোভ। এতে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। চিৎকার, চেঁচামেচি, হট্টগোল ছড়িয়ে পড়ে পুরো কক্ষে। অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন উপাচার্য। একটাই দাবি- ডাকসু ভিপি হিসেবে নুরুল হক নুরকে মেনে নেবে না ছাত্রলীগ। সিনেট ভবনে একটানা এক ঘণ্টার বেশি সময় বিক্ষোভের পর ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা সিনেট ভবন ছেড়ে ক্যাম্পাসে বেরিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। গতকাল সকালে দেখা যায়, নীলক্ষেত মোড়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ছাত্রলীগ কর্মী ও সমর্থকরা ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন ‘প্রহসনের নির্বাচন মানি না, মানব না।’ পুলিশের উপস্থিতিতেই স্লোগান, মিছিল ও টায়ারে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করে ছাত্রলীগ। তারা ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধেও স্লোগান দেন। তাদের দাবি, নুরুল হক জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাই তাকে তারা ভিপি হিসেবে মানবেন না। বিক্ষোভের সময় উপাচার্য তার বাসভবনেই ছিলেন। সকালে প্রতিবাদস্থলে উপস্থিত হয়ে ডাকসুর নবনির্বাচিত জিএস ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মভিত্তিক দল বা শিবিরের রাজনীতি থেকে মুক্ত। নুরুল হক জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়। তাই আমাদের সংগঠনসহ সাধারণ অনেক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করছেন।’ একই সময়ে ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। ‘সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে টিএসসিতে সমাবেশ করেছে স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থী-সমর্থকদের একাংশ। বাম জোটের নেতা-কর্মীরা টিএসসিতে অবস্থান নিয়ে ‘জালিয়াতির নির্বাচন মানি না, মানব না’ স্লোগান দিতে থাকেন। ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিলও করেন সবাই। বেলা দেড়টার দিকে হাসপাতাল থেকে ক্যাম্পাসে আসেন নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর। বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদসংলগ্ন গেট দিয়ে প্রবেশ করে মিছিলের স্লোগান হতে থাকে ‘ছাত্রবন্ধু নুর ভাই, কারচুপিতেও হারে নাই’। পরে তারা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও কলাভবন ঘুরে টিএসসিতে পৌঁছানোর পর নুরুল হক নুরের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। হামলার পর নুরুল হকের নেতৃত্বে টিএসসি থেকে ফের মিছিল বের করেন কোটা আন্দোলনকারী, স্বতন্ত্র প্রার্থী, বিভিন্ন বাম সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি টিএসসি থেকে কলাভবন ও মল চত্বর হয়ে রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে শেষ হয়। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে নুরুল হক নুর প্রশাসনের উদ্দেশে বলেন, ‘আগুনের স্ফুলিঙ্গ নিয়ে খেলবেন না, পুড়ে ছারখার হয়ে যাবেন। ফল ঘোষণা নিয়েও নাটক করা হয়েছে। রাত ৩টার দিকে ফল ঘোষণা করা হয়েছে, আমাদের বিতর্কিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিচ্ছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ গুজবের সংগঠন। তারা গুজবের জন্ম দেয়। প্রশাসন ছাত্রলীগের অপকর্মের সহযোগী।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের নিয়ে খেলবেন না। কারচুপি নির্বাচনের পরও আমি ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। বাকি পদগুলোতেও ছাত্রলীগ জেতেনি। তাদের জিতিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই পুনর্নির্বাচন দাবি করছি।’ ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে বিকাল ৩টা। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে তখনো অবস্থান করছিলেন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এ সময় সেখানে উপস্থিত হন ছাত্রলীগ সভাপতি পরাজিত ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। তিনি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের অনুরোধ করেন উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে সরে যাওয়ার। এ সময় শোভন বলেন, ‘আমাদের সবাইকে নিয়েই চলতে হবে। ক্যাম্পাসের পরিবেশ ঠিক রাখতে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে চাই। আমরা আমাদের অভিভাবকদের সঙ্গে বেয়াদবি করতে পারি না। সবাইকে অনুরোধ করব, এখান থেকে সরে যেতে।’ বেশ খানিক সময় অনুরোধ করার পর ৩টা ৪৫ মিনিটে ওই এলাকা থেকে ছাত্রলীগ কর্মীরা সরে যান। বিকাল সোয়া ৪টায় নেতা-কর্মীদের নিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি যান টিএসসি মিলনায়তনে। সেখানে ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরকে বরণ করে নেয় ছাত্রলীগ। বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, ‘আমি পারিনি, নুরুল হক পেরেছে। আমাদের সবার চাওয়া-পাওয়া নুরুল হক পূরণ করবে। সেজন্য সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, যেন স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ঠিক থাকে।’ এ সময় ডাকসু ভিপি নুরুল হক বলেন, ‘আমি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে চাই। আমরা শিক্ষার্থীদের রায় মেনে নিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করব।’ তিনি বলেন, ‘আমার ওপর ছাত্রলীগ যে হামলা করেছে, তার বিচারের দায়িত্ব আমি ছাত্রলীগ সভাপতির ওপর দিলাম। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের যে ঘোষণা দিয়েছিলাম, তা প্রত্যাহার করে নিলাম।’ পরে টিএসসি মিলনায়তনে বিজয়ী ও বিজিত নুর ও শোভন কোলাকুলি করেন।

এদিকে নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় তফসিল ঘোষণার দাবিতে গতকাল সন্ধ্যা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অনশন শুরু করেছেন ছয় শিক্ষার্থী। সেই সঙ্গে উপাচার্য, প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত সবার পদত্যাগ দাবি করেছেন তারা। অনশন করা চার শিক্ষার্থী হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শোয়েব মাহমুদ, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের মো. মাইন উদ্দীন, দর্শন বিভাগের অনিন্দ্য মন্ডল এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের তাওহীদ তানজিম।

সর্বশেষ খবর