বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

নতুন ভোটের আলটিমেটাম

তিন দিনের মধ্যে দাবি মেনে ৩১ মার্চের মধ্যে নির্বাচন চান নুর, দুই স্থানে অনশনে ছাত্র-ছাত্রীরা। নিয়ম অনুযায়ী শপথ : ভিসি

নিজস্ব প্রতিবেদক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

নতুন ভোটের আলটিমেটাম

বাম থেকে- সংবাদ সম্মেলনে নুরুল হক নুর, উপাচার্য আখতারুজ্জামান, নতুন করে ভোটের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও অনশন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে নতুন করে ডাকসু ভোটের দাবি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আলটিমেটাম দিয়েছেন নব নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর। গতকাল তিন দিনের মধ্যে দাবি মেনে নেওয়ার আলটিমেটাম দেন তিনি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, নির্বাচন-পরবর্তী প্রত্যেকটি প্রক্রিয়াই যথাযথ রীতিনীতি অনুসরণ করে গৃহীত হবে। নিয়ম অনুযায়ী হবে শপথ। এদিকে পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে ছাত্রলীগ ছাড়া বাকি সব সংগঠন। একই সঙ্গে রোকেয়া হলের ঘটনা নিয়ে মামলা দায়েরকে ঘিরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। মঙ্গলবার সারা রাত বিক্ষোভ করেছেন রোকেয়া হলের ছাত্রীরা। গতরাত ৯টা থেকে হলের ফটকে অনশন শুরু করেছেন পাঁচ ছাত্রী। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে পুনর্নির্বাচন ও ‘ভোট জালিয়াতি’তে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের পদত্যাগের দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে অনশন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থী। তবে জানা যায়, ডাকসু ও হল সংসদে দায়িত্ব গ্রহণ করতে শপথ নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। যে মুহূর্তে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল প্রকাশ হয়, তখন থেকেই বিজয়ীরা নির্বাচিত বলে গণ্য হন। অভিষেক অনুষ্ঠান কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নয়।

তিন দিনের মধ্যে দাবি মেনে ৩১ মার্চের মধ্যে নির্বাচনের আলটিমেটাম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সদ্য নির্বাচিত সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর বলেছেন, শিক্ষার্থীরা আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। তারা চাইলে আমি শপথ নেব, না চাইলে নেব না। গতকাল হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় নুর ডাকসুর সব পদে আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে পুনর্নির্বাচনের দাবিও জানান। এ দাবি মানতে প্রশাসনকে তিন দিনের আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। নুর বলেন, আমার পদ আমি বড় মনে করি না। যেহেতু শিক্ষার্থীরা সব পদে পুনর্নির্বাচন চান, আমিও তাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করছি। আবারও নির্বাচন দিতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা যেহেতু আমাকে নির্বাচিত করেছেন, তাদের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দেব। তারা চাইলে আমি শপথ নেব। না চাইলে নেব না। সময় গেলেই বিষয়টি বোঝা যাবে। সব পদেই পুনরায় নির্বাচন চান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই, সব পদে পুনর্নির্বাচন চাই। কেননা, কারচুপির মধ্যে আমি নির্বাচিত হয়েছি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি আরও পাঁচ হাজার ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হব। নির্বাচন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আমাদের প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাজানো ছকের নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। সেজন্য আমরা তাদের বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, এ প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তারা আমাদের কথা মানেননি। তারপরও আমরা নির্বাচনে এসেছি। আপনারা দেখেছেন, কুয়েত মৈত্রী হলে ব্যালটে সিল মারা হয়েছে। রোকেয়া হলে একটি কক্ষে ব্যালট অরক্ষিতভাবে রাখা হয়েছিল। আমরা দেখতে গেলে আমাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বরং আমাদের মারার জন্য হল প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদা হল শাখা ছাত্রলীগের নেত্রীদের ডেকে নেয় এবং তারা আমার ওপর হামলা চালায়। তাদের লেডি মাস্তান বাহিনী শোভন ভাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমরা দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো অলিখিতভাবে ইজারা নেওয়া ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন জোর করে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তাদের প্রত্যেককে বলেছে, তারা যেন ভোট দিতে গিয়ে ১০-১৫ মিনিট সময় নষ্ট করে। ভোট দিয়ে আবার যেন লাইনে দাঁড়ায়। তাই ওই দিনই আমরা এই তামাশার নির্বাচন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কিত করার নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। তারপরও আমরা দেখেছি, আমাদের প্যানেলের আমাকে এবং আখতারকে তারা হারাতে পারেনি। কিন্তু নীলনকশা করে অন্যদের হারিয়ে দিতে পেরেছে। ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো পুনর্নির্বাচন চাচ্ছে। আজকে ভিসি স্যারকে তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়েছি। আমি তাদের নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করি। দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে নুরুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের থেকে পরিষ্কার বার্তা পাওয়ার পর আমরা আমাদের করণীয় ঠিক করব। রোকেয়া হল প্রাধ্যক্ষ আমাদের ছাত্র বন্ধুদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দিয়েছে। অন্যান্য হলেও দু-একটি মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। তিনি বলেন, শোভন ভাই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তিনি আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। কিন্তু তার আগে তারই কর্মীরা আমার ওপর হামলা চালিয়েছে। রোকেয়া হলেও তারা আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তারপরও যেহেতু তারা বলেছে, তারা আমাদের সহযোগিতা করবে, আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

নিয়ম অনুযায়ী শপথ : উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনা নাকচ করে বলেন, আমাদের বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ, আবাসিক শিক্ষকবৃন্দ, রিটার্নিং অফিসার, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চারশ সহকর্মী এই নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত। সুতরাং এত মানুষের আন্তরিকতা, তাদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি, তাদের সময়-শ্রম, সেটির দ্বারা অর্জিত একটি বড় আকারের কর্মযজ্ঞের যে ফল, সেটাকে নস্যাৎ করা কিংবা অশ্রদ্ধা করার ক্ষমতা আমার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নষ্টের চেষ্টা সহ্য করা হবে না। নির্বাচন-পরবর্তী প্রত্যেকটি প্রক্রিয়াই যথাযথ রীতিনীতি অনুসরণ করে গৃহীত হবে বলেও জানান তিনি। গত সোমবার ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে পুনর্নির্বাচনসহ চার দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে মিছিল বের করে পাঁচটি প্যানেল। এর মধ্যে ছিল- কোটা আন্দোলনের প্লাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’, বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রগতিশীল ছাত্রঐক্য, স্বতন্ত্র জোট এবং স্বাধিকার স্বতন্ত্র জোটসহ নির্বাচনে অংশ নেওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তারা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন। মিছিলে অংশ নেন বামপন্থি জোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী, স্বতন্ত্র জোটের ভিপি প্রার্থী অরণী সেমন্তী খান, ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও জিএস প্রার্থী মো. রাশেদ খান, স্বতন্ত্র জিএস প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান, বাম জোটের জিএস প্রার্থী উম্মে হাবিবা বেনজীর, এজিএস সাদিকুল ইসলাম সাদিক, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের এজিএস প্রার্থী ফারুক হোসেন ও স্বাধিকার স্বতন্ত্র জোটের এজিএস প্রার্থী আবু রায়হান খানসহ সংগঠনগুলোর প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিলটি কলাভবন, মধুর ক্যান্টিন ঘুরে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে এসে অবস্থান নেয়।

এ সময় মিছিলে যোগ দেন ডাকসুর সদ্য নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর। তিনি ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষে চার দফা দাবি উত্থাপন করে বলেন, প্রশাসন নীলনকশা অনুযায়ী নির্বাচন করেছে। তারপরও তারা আমাকে এবং আখতারকে (সমাজসেবা সম্পাদক পদে নির্বাচিত) হারাতে পারেনি। কিন্তু অন্যদের পেরেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমরা আরও বেশি ভোটে নির্বাচিত হতাম। তাই এই নির্বাচন বাতিল করে ছাত্রনেতাদের মতের ভিত্তিতে আবার নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচনে ভোট জালিয়াতিতে যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। শনিবারের মধ্যে এসব দাবি মেনে নিতে হবে। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। এরপর ছাত্রনেতারা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে যান। প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনা করেন তারা। অনশনরতদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা : বুধবার দুপুর ১২টার দিকে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে অনশনরত ছয় শিক্ষার্থীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে আসেন কোটা আন্দোলনের প্লাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’, বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রগতিশীল ছাত্রঐক্য, স্বতন্ত্র জোট এবং স্বাধিকার স্বতন্ত্র জোটসহ নির্বাচনে অংশ নেওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ সময় সংগঠনগুলোর পক্ষে একাত্মতার ঘোষণা দেন মো. রাশেদ খান। তিনি বলেন, রোকেয়া হলে হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে যে আন্দোলন চলছে, আমরা তার সঙ্গেও একাত্মতা ঘোষণা করছি। এটা শুধু তাদের দাবি নয়। বরং এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর দাবি। তার প্রত্যক্ষ মদদে রোকেয়া হলে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন বাতিল করে পুনর্নির্বাচন ও ‘ভোট জালিয়াতি’তে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের পদত্যাগের দাবিতে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনশন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থী। অনশনকারী ওই শিক্ষার্থীরা হলেন- পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শোয়েব মাহমুদ, পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. মাইন উদ্দীন, দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের অনিন্দ্য ম ল, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের তাওহীদ তানজীম, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের রনি হোসেন এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাফিয়া তামান্না। এর মধ্যে অনিন্দ্য ম লের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয়েছে। গতকাল এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনশনে যোগ দিয়েছেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র মীর আরাফাত মানব। মানব বলেন, একজন সচেতন ছাত্র হিসেবে ডাকসুর নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন কর্মকা  আমি মেনে নিতে পারছি না। তাই আন্দোলনরতদের সঙ্গে যোগ দিয়েছি। মাইন উদ্দিন বলেন, আমি নিজে স্বতন্ত্র ও প্রগতিশীল জোট সমর্থিত মুহসীন হলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে নির্বাচন করেছিলাম। তবে প্রহসন ও কারচুপির এই নির্বাচন বাতিল করে পুনঃ তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচনের দাবিতে আমরা নেমেছি। গতকাল এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করেনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর