শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
স্বপ্ন ছোঁয়া সম্ভাবনায় বাংলাদেশ

নতুন জাতের ধানে অভাবনীয় সাফল্য

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

দেশের ধান উৎপাদনে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। আর এর পেছনে সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে নতুন নতুন উচ্চফলনশীল ধানের জাত। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন ছিল অতি সামান্য। আর সেই উৎপাদনকে ছাড়িয়ে বিশে^র অন্যান্য সেরা উৎপাদনকারী দেশের সঙ্গে শীর্ষস্থানে ভাগ বসিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) একে একে ৯৪টি ধানের জাত উদ্ভাবন করে এ সাফল্য এনে দিয়েছে। বিশেষ করে গত ১২ বছরে ধানের উৎপাদনে মাইলফলক ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। ৯৪টি জাতের মধ্যে ৪৭টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে গত এক যুগে। এরমধ্যে ছয়টি হাইব্রিড। আরও দুটি উন্নত জাত অবমুক্তির অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আগের হাজারো আদি ধানের জাত এখন আর আবাদ হয় না। যদিও ওইসব জাত বা দেশীয় জাতের নমুনা সংরক্ষণ ও ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছেন গবেষকরা। তবে কেউ কেউ বলছেন দেশীয় ওইসব ধানের জাত এখন বিলুপ্তির পথে। তবে বিলুপ্তির এই বিষয়টি মানতে নারাজ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গবেষকরা। তাদের দাবি, দিন বদলেছে, দেশে চালের চাহিদা বেড়েছে। আর ওইসব দেশীয় ধানের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ করে দিনের পর দিন গবেষণা চালিয়ে উন্নত ও অধিক ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। ব্রি জিন ব্যাংকে সাড়ে আট হাজারের বেশি ধানের জাত সংরক্ষিত আছে বলে দাবি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালকের। ব্রি মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ঠিকই, আবাদি জমি বাড়েনি। প্রতি বছর জমি কমলেও ধানের উৎপাদন বেড়েছে ব্যাপক।

ব্রি জার্মপ্লাজম সেন্টারে ধানের জাতের নমুনার এক সেট সংরক্ষণ করা আছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) জিন ব্যাংকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এরকম মোট প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার ধানবীজের নমুনা অত্যন্ত সযতেœ সুরক্ষিত আছে ইরির রাইস জিন ব্যাংকে। এ ছাড়া নরওয়েতে অবস্থিত গ্লোবাল সিড ভল্টেও এক সেট সংরক্ষণ করা আছে। মাঠে কোনো জাতের বীজ হারিয়ে গেলেও তিনটি স্থানে আলাদাভাবে সংরক্ষিত করা হয়। আর এ কারণে ধানের জাত কখনোই হারিয়ে যায় না। এভাবেই বিলুপ্তির হাত থেকে যুগের পর যুগ কৃষিবিজ্ঞানীরা ধানবীজ রক্ষা করছেন বলে দাবি ব্রি পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা) ড. মো. আনছার আলীর। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতগুলোর মধ্যে সর্বশেষ জাত ব্রি ধান৮৯ সময়ের সবচেয়ে বেশি ফলনশীল বলে জানান বিজ্ঞানীরা। এ ধানে উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ৯ থেকে ৯.৭ মেট্রিক টন। যা কিনা ব্রি উদ্ভাবিত অন্য যে কোনো ধানের জাতের তুলনায় বেশি। জাতটি অতি সহজেই চাষাবাদ করা যায়। গবেষকরা বলেন, ব্রি ধান২৯ এর নতুন সংস্করণ ব্রি ধান৮৯। এই ধানের বৈশিষ্ট্য হলো, পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১০৬ সে.মি.। কা  শক্ত, পাতা হালকা সবুজ এবং ডিগ পাতা চওড়া। ধানের ছড়া লম্বা এবং পাকার সময় কা  ও পাতা সবুজ থাকে। এর জীবনকাল ব্রি ধান২৯ এর চেয়ে ৩-৫ দিন কম এবং ফলন বেশি। ফলন বেশি ও জীবনকাল কম হওয়ায় যেসব এলাকা ব্রি ধান২৯ চাষাবাদ হয় সেখানে সহজেই ব্রি ধান৮৯ চাষ করা যায় বলে দাবি ব্রি গবেষকদের। অন্যান্য বোরো ধানের মতোই পরিচর্যা করতে হয়। এর উপযুক্ত সময় ৫ বৈশাখ-২০ বৈশাখ (১৮ এপ্রিল-৩০ মে)।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে বোরো মৌসুমে ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০ ও ব্রি ধান৫৮ অধিক জনপ্রিয়। অপরদিকে আমন মৌসুমের জাতের মধ্যে বিআর১১ ও ব্রি ধান৪৯ সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত। তবে ব্রি ধান৮৭ ক্রমশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। আউশ জাতের মধ্যে ব্রি ধান৪৮ সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভাবিত ব্রি ধান৮২ ও ব্রি ধান৮৪ও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বলে জানায় ব্রি গবেষকরা।

ব্রি ধান৮৭ জাত পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১২২ সে.মি.। গাছের কা র সময় কা  ও পাতা সবুজ থাকে। চাল আকারে লম্বা ও চিকন। এটি ব্রি ধান৪৯ এর চেয়ে ৭ দিন আগে ফলন হয়। এ জাতের জীবনকাল ১২৭ দিন। ব্রি ধান৮৭ চালের আকার লম্বা ও চিকন হওয়ায় ধানের দাম একটু বেশি ও রপ্তানিযোগ্য। এর ফলন হেক্টরপ্রতি ৬.৫০ মেট্রিক টন।

ব্রি ধান৮৮ বোরো মৌসুমের স্বল্প মেয়াদি ধানের জাত। ব্রি ধান৮৮ জাতটি ব্রি ধান২৮ এর চেয়ে খাটো এবং ঢলে পড়া সহিষ্ণু। ডিগ পাতা খাড়া, লম্বা এবং ধান পাকার পরে সবুজ থাকে। চালের আকার-আকৃতি মাঝারি চিকন হওয়ায় ভাত হয় ঝরঝরে। এ ধানের চালে অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৬.৩% এবং প্রোটিন ৯.৮%। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শীষ থেকে ধান ঝরে পড়ে না। ব্রি ধান৮৮ জীবনকাল ব্রি ধান২৮ এর চেয়ে ৩-৪ দিন কম হওয়ায় হাওরাঞ্চলে চাষাবাদ করা যায়। এ জাতটি ঢলে পড়া প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ও শীষ থেকে ধান ঝরে পড়ে না বিধায় যন্ত্রের সাহায্যে ধান কাটা যায়। এর জীবনকাল ১৪০-১৪৩ দিন। ফলনপ্রতি হেক্টরে গড়ে ৭ মেট্রিক টন। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ৮.৫ মেট্রিক টন ফলন দিতে সক্ষম। চাষাবাদ সময় ১-১৬ অগ্রহায়ণ। প্রচলিত জাতের চেয়ে রোগবালাই ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম হয়। তবে ব্রি ধান২৮ ও ২৯ প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে আলাদা জনপ্রিয়তা রয়েছে। যদিও ২০১৮ সালে উদ্ভাবিত ব্রি ধান৮৯ ফলন এই দুটি জাতের তুলনায় অনেক বেশি।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সূত্রে জানা গেছে, উচ্চফলনশীল ধানের মোট ৯৪টি জাতের মধ্যে ১১টি লবণাক্ততা সহনশীল, পাঁচটি খরাসহিষ্ণু, ৩টি জলমগ্নতা সহিষ্ণু, অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের জন্য দুটি, একই সঙ্গে লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহনশীল একটি, পাঁচটি সরু ও সুগন্ধি চালের ধান, পাঁচটি জিঙ্ক এবং একটি ভিটামিন-এ ধানের জাত রয়েছে। উদ্ভাবিত সর্বশেষ আধুনিক ধানের জাত ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৮৮, ব্রি ধান৮৭, ব্রি ধান৮৬, ব্রি ধান৮৫, ব্রি ধান৮৪, ব্রি ধান৮৩, ব্রি ধান৮২, ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৭৮, ব্রি ধান৭৭, ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭২ ও ব্রি ধান৭১।

সর্বশেষ খবর