শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

মসজিদের নামাজে নিষ্ঠুর হামলা

নিউজিল্যান্ডে শ্বেতাঙ্গ জঙ্গির অতর্কিত আক্রমণে তিন বাংলাদেশিসহ নিহত ৪৯, হামলাকারীর হেলমেটে লাইভ ক্যামেরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

মসজিদের নামাজে নিষ্ঠুর হামলা

বন্দুকধারীর গুলিতে মসজিদে লুটিয়ে পড়েন মুসল্লিরা (বাঁয়ে), আহত একজনকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে -এএফপি

শান্তির দেশ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে জুমার নামাজে বন্দুকধারীদের গুলিতে ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। ক্রাইস্টচার্চের সবচেয়ে বড় মসজিদ ডিন্স এভিনিউর আল নুর মসজিদে প্রথমে নৃশংস এ হামলা চালানো হয়। পরে আরেক মোটরসাইকেল আরোহী বন্দুকধারী পাশের লিনউড মসজিদে হামলা চালায়। হামলায় আহত অন্তত ৪৮ জন ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। নিহতের মধ্যে আছেন তিন বাংলাদেশিও। গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগছেন আরও পাঁচ বাংলাদেশি। তবে সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন নিউজিল্যান্ড সফরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা। তারাও এই আল নুর মসজিদে গিয়েছিলেন জুমার নামাজ পড়তে। ক্রিকেটাররা মসজিদে ঢোকার আগমুহূর্তে এ হামলা শুরু হওয়ায় তারা সেখান থেকে অক্ষত ফিরে আসতে সক্ষম হন। পরে ফেসবুকে লাইভ হওয়া ভিডিও দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুশফিক-তামিমরা। প্রথম হামলাকারী ব্রেন্টন ট্যারেন্ট নামের ২৮ বছরের শেতাঙ্গ ওই যুবকের জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়। খ্রিস্টধর্মের ব্রেন্টন ট্যারেন্ট দাবি করেছেন, ইউরোপে ইসলামপন্থি জঙ্গিদের হামলার প্রতিশোধ নিতেই তিনি এ ন্যক্কারজনক নৃশংসতা ঘটিয়েছেন। স্থানীয় পত্রিকা নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়, দুপুর দেড়টার দিকে মসজিদে নামাজ শুরুর ১০ মিনিটের মধ্যে একজন বন্দুকধারী সিজদায় থাকা মুসল্লিদের ওপর গুলি ছোড়ে। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে হামলাকারী মুহূর্তগুলো সরাসরি ফেসবুকে লাইভ করছিলেন। নিজের হেলমেটে লাগানো গো-প্রো ক্যামেরা দিয়ে তা ভিডিও এবং লাইভ সম্প্রচার করেছেন। এতে দেখা যায়, প্রথমে গাড়ি থেকে নামেন ওই বন্দুকধারী। তখন গাড়িতে গান চলছিল। শান্তভাবেই তিনি গাড়ি পার্ক করেন মসজিদের পাশে। এরপর গাড়ির পেছন থেকে বের করেন একটি অটোমেটিক রাইফেল। সেখানে আরও অস্ত্র রাখা ছিল, দেখে মনে হয়েছে আধুনিক কোনো অ্যাসাল্ট রাইফেল। এর ঠিক ১০ মিনিট আগে জুমার নামাজ শুরু হয়েছে মসজিদে। তিনি শান্তভাবে অস্ত্র হাতে নিয়ে মসজিদে ঢোকেন। এরপর একে একে সামনে যাকেই পেয়েছেন গুলি করেছেন। সরাসরি ভিতরে প্রবেশ করে এলোপাতারি গুলি করতে থাকেন। গুলি শেষ হয়ে গেলে তিনি বার বার ম্যাগাজিন রিলোড করছিলেন। একপর্যায়ে মসজিদের মধ্যে থাকা আহতদের গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এভাবে প্রায় তিন মিনিট ধরে গুলি করে একে একে সবাইকে হত্যার পর শান্তভাবে মসজিদের সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। রাস্তার দিকে যাওয়ার সময় তিনি আশপাশের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। বেরিয়ে আসার পর আরেকটি বন্দুক নিয়ে এসে আবার গুলি করেন। এরপর আর ভিডিওতে কিছু দেখা যায়নি। কিন্তু এরই মধ্যে মৃত্যুর মিছিল দেখে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ শিউরে ওঠে। আল নুর মসজিদে প্রথম হামলার কিছুক্ষণ পর লিনউড মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে।

তিন বাংলাদেশি নিহত : বন্দুকধারীর হামলায় নিহতের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি রয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের অনারারি কনসাল শফিকুর রহমান ভুইয়া। তিনি বলেন, নিহত বাংলাদেশিরা হলেন স্থানীয় লিঙ্কন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবদুস সামাদ, তার স্ত্রী সানজিদা আকতার; অন্যজন হলেন গৃহবধূ হোসনে আরা ফরিদ। নিহত ড. সামাদ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ছিলেন। তার বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার মধুরহাইল্লা গ্রামে; তিনি মৃত জামাল উদ্দিন সরকারের ছেলে। নিউজিল্যান্ডে থাকা নিহত হোসনে আরার ভাগনে মাহফুজ চৌধুরী বলেন, ‘মসজিদের একাংশে নারীরা ও অন্য অংশে পুরুষরা নামাজ আদায় করেন। ঘটনার প্রায় আধঘণ্টা আগে আমার খালা হোসনে আরা তার অসুস্থ স্বামীকে (প্যারালাইজড) নিয়ে মসজিদে যান। সেখানে খালা তার স্বামীকে হুইল চেয়ারে করে মসজিদে পুরুষদের অংশে ভিতরে রেখে নিজে নারীদের অংশে নামাজ আদায় করতে যান। ১৫ মিনিট পর গুলির শব্দ শুনে তিনি তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য বের হন। এ সময় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী তাকে গুলি করলে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা : প্রত্যক্ষদর্শীরা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আল নুর মসজিদে গুলি শুরু হলে তারা প্রাণ বাঁচাতে সেখানে থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান। মসজিদের বাইরে রক্তাক্ত অবস্থায় লোকজনকে পড়ে থাকতে দেখার কথাও জানান তারা। মসজিদ এলাকায় ইবরাহিম নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডকে বলেন, ‘শুরুতে আমি ভেবেছিলাম বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে এমনটা হচ্ছে। পরে দেখি সবাই দৌড়াতে শুরু করেছেন।’ অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘হামলাকারী সামরিকবাহিনীর মতো পোশাক পরে ছিল। হাতে থাকা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে সে ক্রমাগত গুলি ছুড়তে থাকে।’ নুর নামে একজন স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছিলাম। প্রথমে বাইরে গুলির শব্দ হয়। তারপর বন্দুকধারী ভিতরে আসে এবং এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। আমার চোখের সামনে লোকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ছিল। গুলি মসজিদের দেয়ালে আঘাত করছিল। আমি হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।’ তিনি জানান, এ অবস্থায় তিনি হামাগুড়ি দিয়ে মসজিদের একটি জানালার কাছে পৌঁছান। অন্য কেউ পালিয়ে যাওয়ার জন্য সেটির কাচ ভেঙে ফেলেছিল। তিনি সেখান দিয়ে বেরিয়ে পাশের একটি দেয়াল টপকে পালিয়ে যান। শার্টে রক্তের দাগ লেগে থাকা অন্য একজন জানান, প্রাণ বাঁচাতে তিনি একটি বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘গুলি চলছে, আর চলছে। আমাদের সঙ্গে থাকা এক নারীর হাতে গুলি লাগে। যখন গুলি থামে, আমি মসজিদের বেড়ার ওপাশে তাকাই, সেখানে একজন তার বন্দুক পাল্টাচ্ছিল। আমি শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম যেন তার বন্দুকের গুলি শেষ হয়ে যায়।’ অন্য আরেকজন জানান, তিনি বন্দুকধারীকে এক ব্যক্তির বুকে গুলি করতে দেখেছেন। তারপর ওই ব্যক্তি প্রথমে পুরুষদের নামাজের কক্ষের দিকে এবং পরে নারীদের নামাজের কক্ষের দিকে যান।

বাংলাদেশিদের জন্য জরুরি যোগাযোগের নম্বর : অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম সুফিউর রহমান জানিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের স্থায়ী দূতাবাস নেই। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের জন্য জরুরি যোগাযোগের নম্বর দেওয়া হয়েছে। অনারারি কনসাল ইঞ্জিনিয়ার শফিকুর রহমান থাকেন অকল্যান্ডে। তার ফোন নম্বর +৬৪২১০২৪৬৫৮১৯। এ ছাড়া জরুরি যোগাযোগের জন্য ক্যানবেরায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার তারেক আহমেদ +৬১৪৫০৬৫৭০৪৬সহ আরও দুটি নম্বর দেওয়া হয়েছে। নম্বরগুলো হলো, +৬১৪২৪৪৭২৫৪৪ ও +৬১৪৫০১৭৩০৩৫।

ক্রাইস্টচার্চ শহরজুড়ে সতর্কতা, গ্রেফতার ৪ : দুই মসজিদে হামলায় জড়িত সন্দেহে চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী বলে জানান পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ। গ্রেফতার ২০ বছরের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে জানিয়ে বুশ বলেন, শনিবার তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হবে। পুলিশ আরও জানিয়েছে, ক্রাইস্টচার্চের হামলাকারীর গাড়ি থেকে বেশকিছু বিস্ফোরক (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) উদ্ধার করা হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের সেনাবাহিনী সেগুলো নিষ্ক্রিয় করেছে। দুই মসজিদে হামলার পর ক্রাইস্টচার্চ কর্তৃপক্ষ নগরের সব মসজিদ পরবর্তী নোটিস না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। নগরের সব স্কুলও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে হামলার পরপরই আল নুর মসজিদে সন্ত্রাসী হামলাকে ‘গুরুতর ঘটনা’ উল্লেখ করে সতর্ক অবস্থান নেয় পুলিশ। তৎক্ষণাৎ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে শহরের হাসপাতাল ও সব স্কুলে যে যেভাবে আছে, সেভাবেই ভিতরে থাকতে নির্দেশে দেওয়া হয়। বাসিন্দাদের বাসা থেকে বের না হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে লোকজনকে দূরে থাকতে বলা হয়। আপাতত শহরে বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি থাকবে বলে জানানো হয়।

শেখ হাসিনাসহ বিশ্বনেতাদের শোক : নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে হামলায় গভীর শোক ও নিন্দা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নের কাছে পাঠানো এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক ও নিন্দা প্রকাশ করেন। নিন্দা জানিয়েছেন খ্রিস্টান ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার টুইটার বার্তায় বলেন, ‘মসজিদে ভয়ঙ্কর হত্যাকাে র পর নিউজিল্যান্ডের জনগণের প্রতি আমার উষ্ণ সমবেদনা। নিন্দা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। টুইটে তিনি বলেছেন, আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।

হামলায় হতাহত এবং তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। বিবৃতি দিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও। সমবেদনা ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মসজিদে হামলার এ ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন’ এবং ‘সন্ত্রাসী’ বলে বর্ণনা করেছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আরডার্ন।

এ ছাড়া ভয়াবহ এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতা। তাদের মধ্যে আছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন, ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, ফিজির প্রধানমন্ত্রী ফ্যাঙ্ক বেইনিমারামা, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

সন্ত্রাসমুক্ত দাবি করা দেশে এমন হামলা দুঃখজনক : নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে বন্দুকধারীর হামলার ঘটনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, যে দেশ নিজেদের সন্ত্রাসমুক্ত বলে সে দেশে এমন হামলা দুঃখজনক।

তিনি গতকাল সকালে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় আরও বলেন, নিউজিল্যান্ডে আমাদের কোনো দূতাবাস নেই, যে কারণে বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা খোঁজখবর নিতে হচ্ছে। তবে আমাদের ক্রিকেটাররা ভালো এবং সুস্থ আছেন। নিউজিল্যান্ডের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের ক্রিকেটারদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিচ্ছে।

সর্বশেষ খবর