রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

চা চাষে বদলে যাচ্ছে জীবনধারা

পঞ্চগড় ঠাকুরগাঁও দিনাজপুরে অপার সম্ভাবনা

মাহমুদ আজহার

চা চাষে বদলে যাচ্ছে জীবনধারা

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার মমিনপাড়া গ্রামের তরুণ আশরাফ হোসেন রুবেল। দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দীর্ঘদিন বেকার ছিলেন। তার পরিবারেও ছিল চরম অসচ্ছলতা। কত জায়গায় চেষ্টা করলেন, চাকরি হলো না। অগত্যা বাবার কাছ থেকে এক একর জমি নিয়ে শালবাহান রোডের মাঝিপাড়ায় চা চাষ শুরু করেন। দেড়-দুই বছর পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। চা চাষে এসে পড়ল পারিবারিক সচ্ছলতা। রুবেল এখন সাড়ে সাত একর জমিতে চা চাষ করছেন। বিয়ে করেছেন। এক বোনকেও বিয়ে দিয়েছেন। বাবা-মা, ভাই-বোন ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এখন তার সুখের সংসার।

একই উপজেলার ডিমাগজ গ্রামের আনোয়ারুল হকের (৪০) বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অবসরের কিছুদিন পরই মারা যান। বাবার দেনা পরিশোধ এবং পরিবার চালাতে গিয়ে চরম সংকটে পড়ে যান আনোয়ারুল হক। কিছুদিন পরই গ্রামের অন্যদের দেখাদেখি বাড়ির আশপাশের তিন বিঘা জমিতে চা চাষ করেন বিএ ডিগ্রিধারী বেকার আনোয়ার। মাত্র পাঁচ বছরে বদলে গেছে তার জীবন। বাবার দেনা পরিশোধ করে এখন আরও কয়েক বিঘা জমিতে চা লাগিয়েছেন তিনি। আনোয়ারুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র চা চাষের সুযোগ আমার পরিবারকে ঘুরে দাঁড় করিয়েছে।’ দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ করে ভাগ্য বদলে গেছে ক্ষুদ্র চা চাষিদের। শুধু পঞ্চগড়ই নয়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও দিনাজপুরেও এখন ক্ষুদ্র চাষিরা চা চাষ করছেন। এসব এলাকায় বাণিজ্যিকভাবেও চলে চাষাবাদ। তবে পঞ্চগড়ে এখন প্রায় প্রতিটি ঘরেই চা চাষ হচ্ছে। একসময় যেসব জমির কোনো মূল্যই ছিল না, বাড়ির আনাচে-কানাচের সেসব পতিত জমিতে চা চাষ করছেন তারা। মাত্র কয়েক বছর আগেও এসব জমিতে কোনো ফসলই হতো না। এখন ওই জমিতে একটি পাতা দুটি কুঁড়ির বাগান। দিন দিন বাড়ছে চা চাষের পরিধি। চায়ের মান ভালো হওয়ায় ইতিমধ্যে পঞ্চগড়ের চা আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রবেশ করেছে। সিলেটের চা বাগানগুলোয় উৎপাদন কমে যাওয়ায় দিন দিন চাহিদা বাড়ছে পঞ্চগড়ের চায়ের। ক্ষুদ্র চা চাষিরা জানান, চা চাষ করে অল্প খরচে বেশি লাভ পাচ্ছেন তারা। তা ছাড়া চারা রোপণের দুই বছরের মধ্যেই খরচ উঠে আসে। এরপর তারা বলছেন, সরকারি আরও পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। পঞ্চগড় নর্থ বেঙ্গল সেন্ট্রাল টি কারখানার ব্যবস্থাপক আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পঞ্চগড়ের মানুষের জীবনধারাই বদলে গেছে। এখানে দারিদ্র্য নিম্নগামী। চা চাষে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। এখানে আমরা সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে প্রতি কেজি কাঁচা পাতা ২৪ টাকা দরে কিনি। প্রক্রিয়াকরণের পর চলে যায় চট্টগ্রাম।’ বাড়ির সামনে ১৬ শতক সুপারি বাগানে সাথী ফসল হিসেবে চা চাষ শুরু করেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের মহারাজাদীঘি এলাকার শফিকুল ইসলাম। এখন তার বাগানের পরিমাণ ৮৯ একর। ৪০ দিন পর পর মোট চা পাতা সংগ্রহ করেন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ১০০ কেজি। তাতে আয় হয় ৩৬ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। সদরের শালবাহান ইউনিয়নের মাঝিপাড়ায় পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়ক-ঘেঁষে বাড়ির সামনের ভিটায় পাঁচ শতকজুড়ে চা বাগান করেছেন ইয়াসিন আলী। দুই বছর বয়সী এ বাগান থেকে এর মধ্যেই তিনবার পাতা সংগ্রহ করেছেন তিনি। পঞ্চগড় জেলায় অনেক বসতবাড়ির চিত্রই এখন এমন। জানা যায়, নব্বইয়ের দশকে প্রথমে টবে, পরে পতিত জমিতে চা বাগান করা শুরু করেন পঞ্চগড়ের মানুষ। তবে ২০০১ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানি সেখানে চা চাষ শুরু করলে বাণিজ্যিক চা বাগানের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় জানায়, মার্চ থেকে নভেম্বর চা উৎপাদন মৌসুম। পর্যায়ক্রমে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। ২০১৪ সালে সবুজ চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে ৬৩ লাখ ২৭ হাজার ৪২৭ কেজি। ২০১৭ সালে তা উন্নীত হয়েছে ২ কোটি ৫১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৬৯ কেজিতে। চলতি বছর উৎপাদন গত বছরকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ঠাকুরগাঁও : জেলার ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার নিটলডোবা গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হওয়া চা বাগানে এখন উৎপাদন শুরু হয়েছে। ফলে বেড়েছে কর্মসংস্থান। সীমান্তের দুই প্রান্তের মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে সৌহার্দ্য। বালিয়াডাঙ্গীর নিটলডোবা গ্রামের ওপারে ভারতের ইসলামপুর থানার কুকরাদহ সীমান্ত। ভারতীয় অংশে লাগানো হয়েছে বড় বড় চা গাছ। মাঝখানে মাত্র ১০০ গজ নাগর নদ বহমান। ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও পঞ্চগড় জেলার প্রায় ১৪৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার ৪০০ গজের মধ্যে বাংলাদেশিরা বিএসএফের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ভয়ে চাষাবাদ করত না। ফলে ওই ১৪৮ কিলোমিটার এলাকাই পতিত থাকত। ২০০৫ সালে কানিজ ফাতেমা নামক এক উদ্যোক্তা নাগর নদের তীরে প্রায় ২৬ একর জমি কিনে ১৯ একরে চা বাগানের কাজ শুরু করেন। ২০১০ সালের পর থেকে শুরু হয় চা পাতা উৎপাদন।

দিনাজপুর : দিনাজপুর অঞ্চলের বীরগঞ্জ, কাহারোল ও বোচাগঞ্জ উপজেলায় আগামী ২০২১ সালের মধ্যে ৬২ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ সম্প্রসারণে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। এর বাইরের জমিও এর আওতায় আনা হবে। এজন্য এ পর্যন্ত ১৪ জন চাষি রেজিস্ট্রেশন করেছেন। বিরামপুরের ধানজুড়ির তিন-চার কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে সোনাজুড়ি গ্রামের প্রায় ৯ বিঘা জমিতে মুক্তার হোসেন, বীরগঞ্জের পলাশবাড়ী ইউপির ঝলঝলি গ্রামের নজরুল ইসলামের দুই একর জমি, ঝলঝলি গ্রামে মিশনের প্রায় পাঁচ একর জমি, শিবরামপুরে মিজানুর রহমান ও নুরুল ইসলাম ৭৫ শতক জমি, পলাশবাড়ীতে মাহবুর রহমান বুলেটের ১ একর জমি এবং পাল্টাপুর গ্রামের আবুল কালাম আজাদের এক একরসহ বিভিন্ন স্থানে আরও অনেক চাষি চা চাষ করছেন।

(রিপোর্ট তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন পঞ্চগড় প্রতিনিধি সরকার হায়দার, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি আবদুল লতিফ লিটু ও দিনাজপুর প্রতিনিধি রিয়াজুল ইসলাম)।

সর্বশেষ খবর