বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

শিক্ষার্থীদের সেই ৯ দফার ৭টিই বাস্তবায়ন হয়নি

কাগজপত্র নেই উপসচিব ও পুলিশের গাড়িরও চেক করল ছাত্ররা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে বাসচাপা দিয়ে হত্যার ঘটনায় টানা ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে উত্থাপিত নয় দফা দাবির মধ্যে সাতটিরই কোনো অগ্রগতি হয়নি। দুর্ঘটনার আট মাস পার হলেও গুরুত্ব পায়নি এসব দাবি। যদিও শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার ও পরিবহন মালিক সমিতি। কিন্তু এগুলোর কোনোটির বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষার্থীদের নয় দফার মধ্যে ছিল- বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে অভ্যস্ত ড্রাইভারকে ফাঁসি দিতে হবে এবং এ বিধান সংবিধানে সংযোজন করতে হবে, নৌপরিবহন মন্ত্রীকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ করতে হবে এবং লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না, বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না, শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার দিতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে, শিক্ষার্থীরা সিগন্যাল দিলে বাস থামিয়ে তাদের তুলে নিতে হবে, শুধু ঢাকা নয় সারা দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এর মধ্যে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ জাতীয় সংসদে অনুমোদন হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে। সাবেক নৌমন্ত্রী ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন। কিন্তু বাকি দাবিগুলো পূরণে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এর প্রমাণ রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারের অবাধ বিচরণ। শিক্ষার্থীদের তৃতীয় দাবি ছিল ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না। কিন্তু সর্বশেষ ঘটনায় দেখা গেছে, বাস চালানোর লাইসেন্স ছাড়াই বহাল তবিয়তে দীর্ঘদিন ধরে সুপ্রভাত সিটিং সার্ভিসের বাস চালাচ্ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। শুধু মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স ছিল সিরাজুলের। সেই লাইসেন্স নিয়েই এতদিন ধরে তিনি বাস চালকের কাজ করে আসছিলেন। এছাড়া রাজধানীতে চলাচলকারী অধিকাংশ বাসেই গাদাগাদি করে তোলা হচ্ছে যাত্রী। বাসচালকরা যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা করছেন। অনেক ক্ষেত্রে চলন্ত অবস্থায় বাস থেকে যাত্রীদের নামতে বাধ্য করা হচ্ছে। বাসের পাদানিতেও যাত্রীদের ঝুলতে দেখা যায়। অথচ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ বাস থামার জায়গা চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছে, কিন্তু বাস চালাকরা একে অবজ্ঞা করে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএসে ফুট ওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা স্থাপনের দাবিও এখন পর্যন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বলা হচ্ছে, এটির পুরো ফল পেতে আরও সময় লাগবে। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল প্রতিটি সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় গতিরোধক স্থাপন করা। এ দাবির সম্পূরক হিসেবে সব স্কুলের সামনে গতিরোধক নির্মাণের পাশাপাশি বিশেষ প্লাকার্ডযুক্ত বিশেষ ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগেরও নির্দেশনা ছিল। এটিও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নেওয়ার দাবি থাকায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে এ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও সারা দেশে এ প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের বাসে ওঠানোর যে দাবি ছিল সে বিষয়েও পরিষ্কার কোনো নির্দেশনা আসেনি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার বিষয়ে সিটিং সার্ভিস নামধারী পরিবহনগুলোতে কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। এর ফলে প্রায়ই বাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হেলপার কিংবা সুপারভাইজারের বাকবিত-ার ঘটনা ঘটছে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীদের দাবি অবমূল্যায়নের পাশাপাশি নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিও রাখেনি সরকার ও পরিবহন মালিক সমিতি।

বেপরোয়া বাস চলাচল বন্ধে দেওয়া প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধ করার বিষয়টি। এছাড়া চলন্ত বাসের দরজা বন্ধ রাখা, চালক ও সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর এবং মোবাইল নম্বর বাসের ভিতরে দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন, চুক্তিভিত্তিক বাস চালানো বন্ধ এবং বাসের চালকদের সিটবেল্ট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। এর কোনোটাই আট মাসে বাস্তবায়ন হয়নি।

কাগজ নেই উপসচিব ও পুলিশের গাড়িরও চেক করল ছাত্ররা : গাড়ির কাগজপত্র না থাকায় পুলিশের প্রিজনভ্যান ও এক উপসচিবের গাড়ি আটকায় শিক্ষার্থীরা। পরে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় এসব গাড়িতে ‘ভুয়া’ লিখে দেয় তারা। গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ট্রাফিক সার্জেন্টের ন্যায় গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করে। নিজেরাই নেমে পড়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজে। এ সময় শাহবাগে গাড়ির কাগজ পরীক্ষা করার সময় তারা দেখে উপসচিবের গাড়ির কোনো কাগজপত্র নেই। এর আগেও গত বছরের জুলাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবাদে টানা এক সপ্তাহের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করেছিল।  জানা গেছে, রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকা থেকে শাহবাগ যাওয়ার পথে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্টিকার লাগানো ঢাকা মেট্রো খ-১২০৫১৬ নম্বরের গাড়ি আটকে লাইসেন্স দেখতে চায় আন্দোলনরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চালক আমতা আমতা করে সরকারি গাড়ি বলতেই শিক্ষার্থীরা ভুয়া ভুয়া বলে চিৎকার করতে থাকে। গাড়িটির মালিকের পরিচয় জানতে চাইলে চালক বলে, তার স্যার উপসচিব। এ সময় শিক্ষার্থীরা সাইন পেন দিয়ে গাড়ির বনেটে ‘ভুয়া’, ‘লাইসেন্স নাই’, ‘ঘুষের টাকায় কেনা গাড়িতে লাইসেন্স লাগে না?’ ইত্যাদি লিখে দেয়। পরে গাড়িটি রেখে চলে যায় চালক। একই সময় মৎস্য ভবন থেকে পুলিশের একটি প্রিজনভ্যান শাহবাগ সিগন্যালে এলে শিক্ষার্থীরা পথরোধ করে লাইসেন্স দেখতে চায়। লাইসেন্স দেখাতে না পারায় সেই গাড়িতেও ‘ভুয়া’ লিখে পিছু হটতে বাধ্য করে। এ ছাড়া শাহবাগে দুজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার গাড়ি আটকে দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

 এ সময় এক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা গাড়ি থেকে নেমে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। তবে শিক্ষার্থীরা চালকের কাগজ ছাড়া গাড়িটি ছাড়তে চায়নি। পরে গাড়ির চালক তার লাইসেন্স দেখালে গাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে এ গাড়ির সামনেও শিক্ষার্থীরা ভুয়া লিখে দেয়। এরকম মোটরসাইকেল, অটোরিকশার কাগজপত্র পরীক্ষা করেও ওকে লিখতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। কাগজপত্র চেক করার সময় চালকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কথা কাটাকাটিও হয়।

সর্বশেষ খবর