শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নতুন করে সংকটে পড়েছে বিএনপি। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পারস্পরিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তারা। গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে দলটির নেতা-কর্মীদের। এ গ্রেফতার এড়াতে ফের আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে সদ্য কারামুক্ত নেতাদের। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকও করতে পারছেন না দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্যরা। দলীয় কার্যালয় বন্ধ। স্থবির হয়ে পড়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। সব মিলে পঞ্চমুখী সংকটে পড়েছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। গণ গ্রেফতারের বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এখন পর্যন্ত সরকারের হিসাবেই বিরোধী দলের প্রায় ৩ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যা জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও লজ্জার। এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃত নেতা-কর্মীকে গুম করে রেখে নির্যাতন চালিয়ে তিন/চার কিংবা পাঁচ দিন পর আদালতে হাজির করা হচ্ছে। যা আইন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। দেশের নাগরিকদের গুম করে রাখার ভয়াবহ সংস্কৃতি চালু রেখে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করা হচ্ছে। সরকারকে এ ধরনের রোমহর্ষক কর্মকান্ড পরিহারের আহ্বান জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগে থেকেই মামলায় জর্জরিত প্রায় সব নেতা-কর্মী। এখন আবারও নেতা-কর্মীদের নামে মামলা হচ্ছে। চলছে গ্রেফতার অভিযান। এরই মধ্যে অর্ধশত কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৩ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার এড়াতে নিজেদের বাসাবাড়িতে না থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে সাংগঠনিক কর্মকান্ডেও দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় নেতা-কর্মীদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ফলে তারা ভার্চুয়াল সভাও করতে পারছেন না। রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশ তালা লাগানোয় আরও জটিলতায় পড়েছেন দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নিহত, আহত, নিখোঁজ, গ্রেফতার ও মামলার আসামি হওয়া নেতা-কর্মীর তালিকা করার কাজ চলছে বলে জানা যায়।
বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হত্যা, আহত, গ্রেফতারের তথ্যসহ বিস্তারিত ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকদের অবহিত করবে বিএনপি। এ নিয়ে দলটির একটি টিম তথ্য সংগ্রহ করছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় ওই তথ্যাদি পাঠানো হবে।
তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী পরিস্থিতিতে দলের করণীয় কী হবে, তা এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি বিএনপি। দলের জন্য এটি একটি বড় রকমের সংকট। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সপ্তাহ খানেক ধরে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়ালি সভা করা যায়নি। বিএনপির দপ্তর শাখার প্রধান ও দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ গ্রেফতার হওয়ায় এবং দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মূল গেটে পুলিশ তালা দেওয়ার পর বিএনপির দপ্তর শাখাটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মামলা-হামলা আর গ্রেফতারের আতঙ্কে বেশির ভাগ নেতা-কর্মীই এখন আত্মগোপনে। এর ফলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের ক্ষতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীদের পুরোপুরি চিত্র নেই দলটির কাছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যোগাযোগমাধ্যম সরকার বন্ধ রাখায় আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের দলের অফিসগুলোতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে কম্পিউটার সামগ্রীসহ সবকিছু নিয়ে গেছে। গণহারে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় শুধু বিএনপিই সংকটে নেই, সংকটে পড়েছে সমগ্র বাংলাদেশ। সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর আঘাত নতুন কিছু নয়। হামলা, মামলা, গ্রেফতার-এসব দীর্ঘদিন ধরেই মোকাবিলা করে আসছে দলটি। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবিতে শুরু থেকেই নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি। একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দল হিসাবে যৌক্তিক দাবির পক্ষে বিএনপির থাকাটাই স্বাভাবিক। জনগণের দল হিসেবে বিএনপি তার দায়িত্ব থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। এটি কোনো অপরাধ নয়। তাই বলে দেড় শতাধিক ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হবে? আর নাশকতার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের গ্রেফতার না করে নিরপরাধ বিএনপিসহ বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এতে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে নতুন করে আরেকটি অপরাধ সংঘটিত করছে, যার সুযোগ সরকারই করে দিচ্ছে।
জানা যায়, দলের সরাসরি নির্দেশনা না থাকলেও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের অনেকে আহত হয়েছেন, নিহতও হয়েছেন। আবার অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। গ্রেফতার হয়ে কারাগারেও গেছেন অনেক নেতা-কর্মী। সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেফতার নেতা-কর্মীর সঙ্গে দলটির যোগাযোগব্যবস্থা অনেকটা ভেঙে পড়েছে। বিশেষ করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দপ্তরের দায়িত্বশীল অনেক নেতাই আছেন আত্মগোপনে। দলের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনায় জটিলতা বাড়ছে। কোনো তথ্যই পাচ্ছেন না দলটির নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে আহত নেতা-কর্মীর চাপে হিমশিম অবস্থা বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্বশীল নেতাদের। চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাবের নেতারাও আছেন বেশ চাপে। একজন চিকিৎসক জানান, শুধু ঢাকাতেই দুই শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।
বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আন্দোলনে হতাহতদের পুরো তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি তারা। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নেতাকর্মীর খোঁজ নিতেও পারছেন না। ফলে পাশে দাঁড়াতে পারছেন না গ্রেফতার নেতাকর্মীদের। নিহত নেতা-কর্মীর জন্যও কিছু করতে পারেননি তারা। সব মিলিয়ে একটা জটিল পরিস্থিতি তথা মারাত্মক সংকটে রয়েছে দলটি।
এর মধ্যে গত কয়েক দিনে বিএনপি ও তাদের মিত্র রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির অন্তত অর্ধশত কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমান, জহিরউদ্দিন স্বপন, রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন আহমেদ অসীম, ডা. রফিকুল ইসলাম, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, মীর নেওয়াজ আলী, অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল আলম নীরব, সদস্যসচিব আমিনুল হক, মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনুসহ আরও বেশ ক’জন সক্রিয় নেতা। এছাড়া সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) আন্দালিব রহমান পার্থ, জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরসহ আরও বেশ কয়েকজনকে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে শুরু থেকেই নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে ছাত্রদল। এটা সব শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের লড়াই। আর ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও তো শিক্ষার্থী। তারা নিজেদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে থাকবেন-এটাই স্বাভাবিক। তবে ক্ষমতাসীন অবৈধ সরকার যেভাবে গুলি করে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছে, ইন্টারনেট বন্ধ করে সারা বিশ্ব থেকে দেশকে বিচ্ছিন্ন করেছে, তা তাদের ধারণারও বাইরে ছিল।
দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন যুগ্মমহাসচিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের ‘দেখা মাত্রই গুলি করার নির্দেশ’ পেয়ে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে পুলিশ-বিজিবি গুলি করে হত্যা করেছে তা দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ এক ঘটনা। গ্রেফতার নির্যাতন আর গুম-খুন করে এ আন্দোলন সহজেই বন্ধ করা যাবে না। সরকার কারফিউ প্রত্যাহার করে ইন্টারনেট আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর বোঝা যাবে- ছাত্র আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে কি না? শুধু বিএনপির সংকট নয়। এটা সারা দেশের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষের সংকট।