একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইতোমধ্যেই এ প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। দেশে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে লিপ্ত থাকাসহ রাষ্ট্রের জানমাল ক্ষতিসাধনের জন্য সরকারের নির্বাহী আদেশে এই দলকে নিষিদ্ধ করা হবে। যে কোনো সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা এ তথ্য জানিয়েছেন। এদিকে গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াত-শিবিরকে বুধবারের (আজ) মধ্যে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এটি করা হবে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের পর সরকারের সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছেন। এ বিষয়ে গতকাল সরকারের সাত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী একটি বৈঠকও করেছেন। ওই বৈঠকের একাধিক সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জামায়াত শিবিরের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কোটার আন্দোলনে ক্ষয়ক্ষতি ও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে বেশি। জামায়াত নিষিদ্ধ করা নিয়ে সরকার যে কোনো সময় প্রজ্ঞাপন দেবে বলেও জানান দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র। উচ্চ আদালতের রায়ে ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। দলটির ছাত্রসংগঠনের নাম ইসলামী ছাত্রশিবির। জামায়াতের পক্ষ থেকে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর এই আপিল খারিজ করে দেন। ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ হবে : জানা গেছে, এর আগে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য বিভিন্ন সংগঠনকে নিষিদ্ধ করলে সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেই করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তেও সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা শাখা থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র এক কর্মকর্তা জানান, এই ধরনের দলকে নিষিদ্ধের অভিজ্ঞতা আগে নেই। তবে এটি আমাদের মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অনুবিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হবে। যেহেতু এটি সরকারের সিদ্ধান্ত, শুধু মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে। গতকাল রাত ৮টায় রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম টিপু সুলতানের কাছে প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমার কাছে এই মুহূর্তে কোনো তথ্য নেই। যদি সিনিয়র স্যারদের কাছে কোনো খবর থাকে সেটি আমি না জেনে বলতে পারি না। তবে এ-সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন হলে সেটি আমাদের শাখা থেকেই হবে বলে জানান তিনি।
দুই মন্ত্রী যা বললেন : এদিকে গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াত-শিবিরকে বুধবারের (আজ) মধ্যে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এটি করা হবে। আইনমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে নির্দেশনা দিয়েছেন বুধবারের মধ্যে একটি ব্যবস্থা নিতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। কোন আইনি প্রক্রিয়ায় হবে, তা যখন আমরা সিদ্ধান্ত নেব তখন বলব। বুধবারের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ইনশাআল্লাহ। বর্তমানে কোটা আন্দোলন চলছে, জামায়াত-শিবিরের মতো সংগঠন এ মুহূর্তে নিষিদ্ধ করা হলে সরকার কোনো ঝামেলায় পড়বে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, যারা কোটা আন্দোলন করেছে তারা কিন্তু বলেছে, সহিংসতার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত আছে। জামায়াত-শিবির, বিএনপি-ছাত্রদল, যারা জঙ্গি, তারাই এটি করেছে। এ দলকে (জামায়াত) যদি নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা এবং রাজনীতিরও অনেক উন্নতি হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, কোনো দলকে যখন নিষিদ্ধ করা হয়, তখন তা নির্বাহী আদেশেই হয়, বিচার বিভাগীয় আদেশে হয় না। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার এক কথা এবং জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা আরেক কথা। আইনমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর বিকালে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, কারফিউ, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধকরণ, চলমান আন্দোলনসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সাতজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীসহ কয়েকজন সচিব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানদের নিয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকেও আইনমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা ওই বৈঠকে আইনমন্ত্রী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত। এ ছাড়া পররাষ্ট্রসচিব, বাণিজ্যসচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও জননিরাপত্তা বিভাগের দুই সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এবং র্যাব, বিজিবি ও আনসার বাহিনীর প্রধানরাসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আইনমন্ত্রী ইতোমধ্যেই বলেছেন জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রতিবারই জঙ্গির উত্থান বলুন, সন্ত্রাসী কার্যক্রলাপ বলুন তারাই (জামায়াত) করে যাচ্ছে। কাজেই ১৪ দলসহ সবাই মিলে রাজনৈতিক একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে সেটি বাস্তবায়ন হওয়ার জন্য যে সমস্ত প্রক্রিয়া দরকার সেগুলো চলছে। জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া বুধবারের (আজ) মধ্যেই সম্পন্ন হবে কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সেটি আমি বলতে পারব না। প্রক্রিয়া চলছে। সেটার সময় এক ঘণ্টাও হতে পারে, ১০ ঘণ্টাও হতে পারে। এক দিন বা দুই দিন হতে পারে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। এই মুহূর্তে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ থাকবে কি না, নিষিদ্ধ হলে ধ্বংসলীলা চালালে করণীয় কী হবে সরকারের, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি সংগঠন যারা জঙ্গির উত্থান ঘটাতে চেয়েছিল, যাদের দেশের বাইরের সঙ্গে একটা লিঙ্ক ছিল, তাদের কর্মকান্ড আমরা বন্ধ করেছি, নিষিব্ধ করেছি। যেহেতু এখন সব সময় দেখা যাচ্ছে সমস্ত ধ্বংসের পেছনে রয়েছে জামায়াত-শিবির। বাংলা ভাইয়ের যখন উত্থান হয় জামায়াতের আমির সে সময় মন্ত্রী। তখন জামায়াতের আমির বলেছিলেন ‘ওইসব ভুয়া কথা, এগুলো মিডিয়ার সৃষ্টি।’ আসলে তারাই পৃষ্ঠপোষকতা করে এগুলো উঠিয়েছে। যত জঙ্গির উত্থান হয়েছে তার শেকড় টানলে দেখা যায় এগুলো শিবির বা জামায়াতের সদস্য। এ জন্যই এখন সব রাজনৈতিক দল একত্র হয়ে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে।