কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে যেসব মৃত্যু হয়েছে, তা সবার জন্যই দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন হাই কোর্ট। আন্দোলনকারীদের ওপর তাজা গুলি ব্যবহার না করার নির্দেশনা চাওয়ার রিটের শুনানিতে হাই কোর্ট এ মন্তব্য করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে মুক্তি দিতে ও আন্দোলনে তাজা গুলি ছোড়া বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানিতে গতকাল আদালত এ মন্তব্য করেন। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চে রিট আবেদনটির ওপর দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। পরে এ বিষয়ে আরও শুনানি ও আদেশের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন আদালত। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন ও ব্যারিস্টার অনীক আর হক। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনির, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোর্শেদ ও মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী। এদিন এ রিট আবেদনের শুনানি কেন্দ্র করে হাই কোর্টের এ বেঞ্চে আইনজীবীদের বিপুল উপস্থিতি দেখা গেছে। শুনানিতে রিটকারীদের আইনজীবী অনীক আর হক বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় নারায়ণগঞ্জে বাসার ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছয় বছরের শিশু রিয়ার মৃত্যু হয়।’ এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন শুনানিতে তুলে ধরেন তিনি। এক পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘এসব মৃত্যু আমাদের সবার জন্যই দুঃখজনক।’ তখন আইনজীবী অনীক আর হক বলেন, ‘নিঃসন্দেহে (দুঃখজনক)।’ তিনি বলেন, ‘একটা জীবন যখন চলে যায়, তখন কোনো পক্ষ থাকে না। আর এটা ছয় বছরের একটি শিশুর মৃত্যু!’ তখন এ আইনজীবীকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, ‘আমরা কোর্টে ইমোশনাল বিষয় অ্যাড্রেস করব না। আমরা খুব লজ্জিত।’ এরপর আইনি দিক তুলে ধরে অনীক আর হক শুনানিতে বলেন, ‘পুলিশকে যদি গুলি চালাতেই হয়, তবে পা লক্ষ্য করে গুলি করতে হবে। রাতে ডাকাত ধরার ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে শুধু সরাসরি গুলি করতে পারবে।’ এ সময় হাই কোর্ট বলেন, ‘কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে পুলিশ কী আচরণ করবে তা পিআরবিতে বলা আছে।’ অনীক আর হক বলেন, ‘বিটিভি-মেট্রোরেলে যখন আগুন লাগানো হয়েছে তখন একটি গুলিও চলেনি। গুলি হয়েছে মিছিলে। যখন কোনো বিষয় এক্সট্রিম পর্যায়ে চলে যায় তখন ম্যাজিস্ট্রেটের ?নির্দেশে গুলি করতে পারে।’ এ সময় আদালত বলেন, ‘এক্সট্রিম পর্যায়ের বিষয়টি তো কোয়েশ্চেন অব ফ্যাক্ট। আমাদের এমন কোনো কাজ করা উচিত না, যাতে জাতির ক্ষতি হয়।’ এ সময় অনীক আর হক বলেন, ‘জাতির ক্ষতি বলতে শুধু কিছু ভবন, স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি বোঝালে হবে না। জীবনের ক্ষতিও জাতির ক্ষতি। আগে বিক্ষোভ দমন বা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গরম পানি, মরিচের গুঁড়া ব্যবহার করত।’ এ সময় হাই কোর্ট বলেন, ‘টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ব্যবহার করা যেতে পারে। তার আগে মাইকিং করে সতর্ক করতে হবে। আমরা কেউই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছি না। পুলিশ কখন আর্মি কল করতে পারে সেটিও আইনে বলা আছে। পুলিশকে যে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তার খবর ও ছবি খুব একটা প্রচারে আসেনি।’ অনীক আর হকের পর রিটকারীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন। তিনি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)-এর হেফজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের হেফাজত নিয়ে বলেন, ‘ছয় সমন্বয়ককে যে হেফাজতে রাখা হয়েছে, এটা তো স্বীকৃত। আইনে কর্তৃত্ববহির্ভূতভাবে কাউকে এভাবে হেফাজতে রাখার সুযোগ নেই। আইনি ক্ষমতার বাইরে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। বলা হচ্ছে যে, তাদের (ছয় সমন্বয়ক) আত্মীয়স্বজনরা দেখা করতে পারছেন। কিন্তু তারা (ছয় সমন্বয়ক) কার সঙ্গে দেখা করতে চান বা চান না, সেটা জানার কোনো সুযোগ নেই। তার মানে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ চলছে।’ এ সময় আদালত বলেন, ‘একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আটকাতে হবে। হয় রিমান্ডে নিতে হবে, নয় আদালতে তুলতে হবে।’ এরপর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল (অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল) এস এম মুনির। শুনানিতে তিনি ছয় সমন্বয়কের জীবন ঝুঁকি ও হুমকির কথা তুলে ধরেন। আর এ কারণেই ডিবি তাদের হেফাজতে নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তখন হাই কোর্ট বলেন, ‘তাদের যে মেরে ফেলবে এ কথাটা তাদেরই বলতে হবে। সে তো আশ্রয় চায়নি।’ রিট আবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, ‘রিট আবেদনকারীরা ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য এসেছেন। তারা একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। এখানে যারা এসেছেন (রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী) তারা সবাই এ কমিশনের সদস্য। তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান রিট আবেদনকারী একজনের বাবা।’ জাতিসংঘের একটি সনদ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। ওই সনদ অনুসারে অনুপেক্ষিত ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারীরা গুলি চালাতে পারবে। কোনটা অনুপেক্ষিত পরিস্থিতি, সে সিদ্ধান্তও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেই নিতে হবে। এটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।’ এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, ‘আমরা আদালতের ভিতরে আছি। আইনের মধ্যে থেকে কথা বলব। এমন কিছু বলব না, যাতে শুধু মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া যায়।’ এ সময় আদালত বলেন, ‘বিষয়টি সব পক্ষেরই খেয়াল রাখা দরকার। এখন দেশে যে অবস্থা সে পরিস্থিতিতে ছয় সমন্বয়ককে পুলিশ আটকে রাখতে পারে কি না?’ জবাবে আইন কর্মকর্তা মোরশেদ বলেন, ‘দেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কাকে কীভাবে রাখবে সে সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোটা নিয়ে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, সেখানে সর্বোচ্চ আদালত কিছু পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন। আদালত আশা প্রকাশ করেছেন, যে তদন্ত কমিশন সরকার গঠন করেছে সে কমিশন প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করবে। তা সত্ত্বেও তারা (রিট আবেদনকারী পক্ষকে উদ্দেশ করে) গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছে।’ সভাসমাবেশের অধিকার নিয়ে এ আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘আইনি-বিধিনিষেধ সাপেক্ষে সভাসমাবেশের অধিকার দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে বল প্রয়োগ করেছে, তার কোনো প্রমাণ তাদের (রিট আবেদনকারীদের) কাছে নেই।’ শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ এ রিট আবেদনে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন শুনানি করবেন বলে জানান। তখন আদালত বুধবার (আজ) বলে এজলাস কক্ষ ছেড়ে যান।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সরাসরি লাইভ রাউন্ড (তাজা গুলি) ব্যবহার না করার নির্দেশনা চেয়ে সোমবার রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী। তাঁরা হলেন আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা। রিটে কথিত নিরাপত্তার নামে হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দ্রুত মুক্তির নির্দেশনা চাওয়া হয়। রিটে আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, পুলিশের মহাপরিচালক, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানকে বিবাদী করা হয়েছে। এ রিট আবেদনের ওপর সোমবার ও গতকাল দুই দিন শুনানি শেষে আজ ফের শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন আদালত।