ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলছেন, আমাদের সরকার রাজনীতিবিদদের ওপর নির্ভরশীল নয়, প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল। প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ফলে এর দায়িত্বে যারা আছে, তারা জনগণের ক্ষোভ ও দাবি-দাওয়া উপলব্ধি করতে পারে না। এ ছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং রাজনীতি ও অভিজ্ঞতায় নবীন, এমন মন্ত্রীরা সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। যে কারণে সংকটের সমাধান হয় না। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সহিংসতা, হতাহত, সংকট উত্তরণে করণীয়সহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন সাবেক মহাজোট সরকারের এই মন্ত্রী।
সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এখন মুখপাত্র যারা আছেন, তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। ফিল্ডে যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থাকা দরকার ছিল, সেটা নেই। তারা কিন্তু জনগণের পালস বুঝতে পারেন না। যে কারণে বল প্রয়োগ, বন্দুকের ওপর নির্ভরশীল হতে চান। সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের বুলেটের অভাব নেই। এটা বালখিল্যমূলক কথাবার্তা।
দিলীপ বড়ুয়া বলেন, কোটা আন্দোলন শুরু থেকে ছাত্র সমাজের প্রতি যে ¯েœহ দিয়ে কথা বলা দরকার ছিল, সেটা করা হয়নি। বরং হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের দোহাই দিয়েছেন আইনমন্ত্রী । অথচ তিনিই সাত দিনের মধ্যে একটা সমাধান নিয়ে আসলেন। তাহলে শিক্ষার্থীরা যখন দাবি করেছিল, তখন সমস্যার সমাধান করলে ক্ষতি কোথায় ছিল? যার ফলে আজকে হত্যাযজ্ঞ, সরকারকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র, সরকারকে টালমাল করার ক্ষেত্র তৈরি হতো না।
সংকট থেকে সমাধানের পথ কী জানতে চাইলে ১৪ দলের এ নেতা বলেন, ছাত্রদের মনের আকুতিকে সম্মান দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলে আপাতত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে বলে মনে করি। তবে ছাত্র সমাজের আন্দোলন স্থিমিত করার জন্য ছাত্রদের নামে দেওয়া মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। তাদের দাবিগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। তাদের সমস্যাগুলো মেনে নিলে অবশ্যই সংকটের সমাধান হবে। তিনি বলেন, আমাদের ছাত্র সমাজ অবিবেচক নয়, তারা সব উপলব্ধি করতে পারবে, আন্দোলন থেকে তারা সরে আসবে। আন্দোলনকারী ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বসতে হবে। এই বাম রাজনীতিক বলেন, রাশিয়ার একটি সংস্থা সরকারকে ছয় মাস আগে সতর্ক করেছিল, আরব বসন্তের মতো বাংলাদেশে এক ধরনের সমাবেশ হবে। সেটিই হয়েছে। বিএনপি গত ২৮ অক্টোবর সমাবেশ করেছে, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা করেছে। এখনো বিএনপি-জামায়াত মাঠে নামার পাঁয়তারা করেছে। আজকে একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। দিলীপ বড়ুয়া বলেন, আমরা আগেও বলেছি, শুধু সরকার পরিবর্তনের জন্য চক্রান্ত চলছে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা মনে করি এখনো শেখ হাসিনা দেশের মানুষের একমাত্র নির্ভরতার স্থান। এখনো সময় আছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সবাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সংকট উত্তরণ সম্ভব হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। দুর্নীতি ও জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সমালোচনা করে সাবেক মহাজোট সরকারের এই টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী বলেন, জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া, মানুষের আয় নাই। বাজারে গিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস। অথচ বেনজীরের মতো আইজিপি, এনবিআরের মতিউররা হাজার হাজার কোটি টাকা অন্যায়ভাবে আয় করেছে। এজন্য ছাত্র সমাজ অপমানবোধ করেছে। সে কারণে তারা ফুঁসে উঠেছে। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কিন্তু পাঁচ বছর পর দেখা গেল, দুর্নীতি আরও বেড়েছে, দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। মাদকাসক্তি বেড়েছে বহুগুণে। মাদকাসক্তির ভয়াল থাবা যুবসমাজকে গ্রাস করেছে। যে কারণে আমাদের যুব সমাজের সামনে হতাশা ছাড়া কিছুই নেই। এই যুব সমাজ এই ছাত্র সমাজকে একটি গোষ্ঠী কাজে লাগিয়েছে।
১৪-দলীয় জোটের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ২০০৪ সালে আমরা ১৪-দলীয় জোট করি। ১৪-দলীয় জোট গঠনের সময়ে আমাদের লক্ষ্য ছিল, অর্থনৈতিক মুক্তি। আমাদের দাবি ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেক বেশি দেখছি। বলা হয়, আমাদের নাকি ভোট নেই, লোক নেই। এসব বলে অনেক সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। আজকে সংকট মোকাবিলায় ১৪ দলের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। এখন বলতে চাই, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। এখন প্রমাণিত হয়েছে, ১৪ দল রাজনৈতিক ক্রাইসিসের সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আছে।
আওয়ামী লীগকে সংকট মোকাবিলায় জনগণের কাছে যাওয়ার পরামার্শ দিয়ে প্রবীণ রাজনীতিক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, এখনো সময় আছে জনগণকে আশ্বস্ত করতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামতে হবে। জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ও অসহায় মানুষের জন্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়া দরকার। মানুষের কাছে যেতে হবে। মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে। তা না হলে তুষের আগুনের মতো আবারও আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়তে পারে।