১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তাদের সব অঙ্গসংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সরকারের নির্বাহী আদেশে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনি মতামত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়। গত কয়েকদিন ধরে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার আলোচনা চলছিল। সম্প্রতি কোটা সংস্কার নিয়ে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সহিংসতা ও নাশকতাসহ ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর তাদের নিষিদ্ধ করল সরকার।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার। কিন্তু পরে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের সময় আবার রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পায় জামায়াত। এরপর প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে বহুবার। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার পর সে দাবি আরও জোরালো হয়। গতকাল ধর্মভিত্তিক এ দল নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যেহেতু, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং তার অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হইয়াছে; এবং যেহেতু, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন নং-৬৩০/২০০৯-এ ১ আগস্ট ২০১৩ তারিখের প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত/প্রাপ্ত নিবন্ধন বাতিল করিয়া দিয়াছে এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, হাই কোর্ট বিভাগের ওই রায়কে বহাল রাখিয়াছে; এবং যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং তার অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল। এতে আরও বলা হয়েছে, যেহেতু সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সব অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে সেহেতু, সরকার, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করিল। ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে।
গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর কক্ষের সামনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এই দলগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা আর এই নামে রাজনীতি করতে পারবে না। তিনি বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮/১ ধারায় জামায়াত-শিবির ও অন্যান্য যে অঙ্গসংগঠন নিষিদ্ধ, এটা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের যে দ্বিতীয় তফসিল আছে, সেখানে এগুলো তালিকাভুক্ত হবে। জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে কি না? জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, তাদের কী হয়েছে... আপনারা নকশাল বাড়ির ইতিহাস জানেন। অনেক দল যেতে পারে আন্ডারগ্রাউন্ডে। কিন্তু আমি বলেছি, সেটিকে মোকাবিলার প্রস্তুতি আমাদের আছে। পরে বিকাল প্রায় ৪টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান নিজ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, নিষিদ্ধ হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে কোনো সহিংসতা হলে তা দমনের সক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
এর আগে গত সোমবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের বিষয়ে ‘সর্বসম্মত’ সিদ্ধান্ত হয়। এর পরদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বুধবারের মধ্যেই জামায়াত নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন জারি হবে। এরপর বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত অফিস করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাংগীর আলমসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা।
মধ্যরাতে অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে ফাইল আমাদের কাছে এসেছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারায় জামায়াত নিষিদ্ধ হচ্ছে। ওই বিধিতে নিষিদ্ধের ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া আছে। বিস্তারিত প্রজ্ঞাপনে থাকবে। আমরা সব কাজ চূড়ান্ত করেছি। প্রজ্ঞাপন জারির অপেক্ষা মাত্র। এর আগে গত বুধবার দিনভর দফায় দফায় বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এক সময় আইন সচিবও দেখা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। এর আগের দিন গত মঙ্গলবার সাত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও বিভিন্ন বাহিনী প্রধানদের নিয়ে চলমান আন্দোলনসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে জরুরি বৈঠকে উঠে আসে এই জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের বিষয়টি।
এদিকে যে আইনে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেই সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯-এর ১৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, কোন ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সহিত জড়িত রহিয়াছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে’। ১৮ (২) ধারায় বলা হয়, ‘সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে কোন ব্যক্তি বা সত্তাকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে বা তফসিল হইতে বাদ দিতে পারিবে অথবা অন্য কোনভাবে তফসিল সংশোধন করিতে পারিবে’।
পাকিস্তান আমলেও এই জামায়াত দুবার নিষিদ্ধ হয়েছিল। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, উপমহাদেশে দেশভাগের আগে ১৯৪১ সালে দলটি প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদি। ১৯৫৯ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে প্রথমবার পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকান্ড আবারও নিষিদ্ধ করা হয়। তবে পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। সর্বশেষ বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে ১৯৭৭ সালে সংবিধানের ওই ধারা বাতিলের পর ফের রাজনীতিতে আসে জামায়াত। তখন থেকে জামায়াতের বিরোধিতা করে আসছিল সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা।
২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশন থেকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা নিয়ে ২০০৯ সালে রিট করেন তরিকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। এরপর বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে নতুন করে নিবন্ধন চেয়েছিল জামায়াত। সে নিবন্ধনও মেলেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যে রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, ৫৩ বছরেও সেই জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ বা অপরাধী সংগঠন হিসেবে তাদের বিচার শুরু করা যায়নি। এ লক্ষ্যে ১০ বছর আগে আইন সংশোধন করে দলটির বিচারের মুখোমুখি করার উদ্যোগ নিলেও তা এখন অনেকটা হিমঘরে। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায়ও ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। দন্ড কার্যকর হওয়া জামায়াতের শীর্ষ নেতারা হলেন- সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী। রাজাকারের শিরোমণি বলে কুখ্যাত গোলাম আযমকে আমৃত্যু কারাদন্ড দেওয়া হয়। একে একে দলটির ৭৫ নেতা-কর্মী যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডিত হয়েছেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক রায়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত নানা অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এরপর ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিচারের জন্য তদন্ত শেষ করে তদন্ত সংস্থা। তদন্ত শেষ হওয়ার পরপরই প্রসিকিউশনের প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে দল বা সংগঠনের বিচারের সুযোগ না থাকায় ওই সময় বিচার করা যায়নি। এরপর যুদ্ধাপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
নিষিদ্ধ জামায়াতের বক্তব্য প্রচার করা যাবে না : নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন বা ব্যক্তির কোনো বিবৃতি, মন্তব্য, অভিমত, উক্তি কোনোভাবেই প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, জামায়াত এখন নিষিদ্ধ সংগঠন তাই তাদের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে না। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনেই এ বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা আছে বলে জানান তিনি। গতকাল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারির পর সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারা অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দলটির নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে হাই কোর্টের রায়ে। আপিল বিভাগে গিয়েও তারা নিবন্ধন ফিরে পাননি। সর্বশেষ কোটা সংস্কারবিরোধী আন্দোলনে তারা সরাসরি এবং বিভিন্ন ধরনের উসকানি দিয়ে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধের রায়, নিবন্ধন বাতিলের রায় এবং বর্তমান কর্মকান্ড বিবেচনায় নিয়ে সরকার তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর ফলে জামায়াত এখন আর কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এখন তারা নিষিদ্ধ সংগঠন। এ গেজেট চলমান থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনা করলে আইন অনুযায়ী সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যাবে জামায়াতের বিরুদ্ধে।