বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা আবার দেখিয়ে দিল যে, বাধা যত বড়ই হোক না কেন, তাদের থামানো যাবে না। শুরুটা হয়েছিল গত মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এরপর একে একে নিপীড়নকারী সরকারের সঙ্গে রক্তাক্ত আন্দোলনে আওয়ামী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা, নতুন সরকার গঠন করা, নতুন বাংলাদেশে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সামলানো, বাজার মনিটরিংসহ শহরের সৌন্দর্য বর্ধনসহ নানা প্রশংসনীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
ছাত্রদের সঙ্গে এ সময় তাদের কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে তাদের সহযোগিতা ও সমর্থন জুগিয়েছে দেশের সাধারণ মানুষও। এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, সামরিক বাহিনী, সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপ, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল, সামাজিক-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বাদ যাচ্ছে না নিম্নআয়ের দিনমজুররাও। যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী বন্যা দুর্গত মানুষদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছেন। আকস্মিক এই বন্যায় গতকাল বিকাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে ১৮ জনের মৃত্যু হয়। বন্যার্তদের সহযোগিতায় এরই মধ্যে তৃতীয় দিনের মতো গতকালও গণত্রাণ সংগ্রহ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এতে নগদ অর্থের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শুকনো খাবারসহ ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়। শিক্ষার্থীরা এসব ত্রাণ সংগ্রহ করে প্যাকেজিংয়ের ব্যবস্থা করছে। গতকাল সকাল থেকে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত চলে ত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচি। এর আগে গত শুক্রবার কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে ১ কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজার ১৯৬ টাকা জমা পড়ে। এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সাধারণ মানুষ শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগে শামিল হয়েছেন এবং হচ্ছেন। ত্রাণ দিতে এখন টিএসসিতে যেন মানুষের ঢল নেমেছে। ত্রাণ হিসেবে বোতলজাত পানি ও খাবার স্যালাইন, স্যানিটারি ন্যাপকিন, কেউ কেউ মুড়ি চিড়া, বিস্কুট জাতীয় শুকনা খাবার নিয়ে আসছেন। ছোট ছোট শিশুরাও তাদের মাটির ব্যাংক নিয়ে আসছেন। এ ছাড়াও দিনমজুর, ভিক্ষুক, রিকশাচালকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে টিএসসিতে হাজির হচ্ছেন। এ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও হলের শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। কুমিল্লায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টিম বন্যাকবলিত এলাকায় উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করছে। গতকাল লাকসামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের একটি টিম সাড়ে ৪০০ প্যাকেট ত্রাণ বিতরণ করে। এ ছাড়াও দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষার্থীরাও বন্যাকবলিত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসছে। এর বাইরে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বন্যার্তদের জন্য অর্থ ও ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করছেন। তারা ছোট বাক্সে অর্থ সংগ্রহ করছেন। কেউবা বুথ বসিয়ে এলাকাবাসীর কাছ থেকে কাপড়, শুকনা খাবার, পানি ইত্যাদি সংগ্রহ করছেন। এরই মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির কারণে এ বছর জন্মাষ্টমী আয়োজনের ব্যয় সংকোচন করে তা দিয়ে বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণ ও অন্যান্য সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা। গত শুক্রবার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এ কথা জানান। এ ছাড়াও দুর্গোৎসব আয়োজনের বাজেট থেকে বন্যা দুর্গতদের অর্থ সহায়তা পাঠিয়েছে বরিশালের বেশ কয়েকটি মন্দির কমিটি।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে আস-সুন্নাত ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ জানান, তারা এরই মধ্যে ৫০০ টন ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। বসুন্ধরায় বসবাসরত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে সার্বিক সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে এই শিল্পগোষ্ঠী। বন্যাদুর্গত বিভিন্ন এলাকায় খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ২৫ হাজার প্যাকেট ত্রাণ দেওয়া হয়। বসুন্ধরায় বসবাসরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা বন্যার্তদের পাশে থাকার জন্য বসুন্ধরার কাছে সহায়তা চায়। আর শিক্ষার্থীদের আবেদনে দ্রুত সাড়া দেয় বসুন্ধরা গ্রুপ। এ ছাড়া বন্যার্তদের সাহায্যে ১২টি নৌকা ও স্পিড বোটের ব্যবস্থাও করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। বন্যার্তদের সহযোগিতায় এক দিনের বেতন দিচ্ছেন অনেক সরকারি-বেসরকারি শ্রেণি-পেশার মানুষ। সরকারি-বেসরকারি অফিস ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গঠন করা হচ্ছে ত্রাণ তহবিল। নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের এক দিনের বেতন অনুদান হিসেবে বন্যা দুর্গতদের দিচ্ছেন। বন্যাদুর্গত এলাকায় স্পিড বোট ও নৌকার প্রয়োজন হলে এবং কোথাও উদ্ধারের প্রয়োজন হলে নৌযান নিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন অনেকেই। ফেসবুকে এজন্য প্রয়োজনীয় মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। এ ছাড়া বেশ কিছু মানুষ বন্যায় শিশুদের কাপড়, স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট নিয়ে মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসছেন। শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বন্যাদুর্গত সাধারণ মানুষদের সহযোগিতায় দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, কোস্টগার্ড এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি রান্না করা খাবার বিতরণ করছেন তারা। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে তারা চালাচ্ছেন উদ্ধার তৎপরতা।