ছদ্মবেশ ধারণ করতে মুখভর্তি সফেদ সাদা দাড়ি নিজেই কেটেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন বাসা থেকে বের হয়ে ঢাকার চারপাশে ভয়ংকর অবস্থা বুঝতে পারেন তিনি। বিমানবন্দরসহ সব জায়গা থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে সরাসরি চলে যান উত্তরায়। নিজের মালিকানাধীন একটি জুট মিলে। সেখানে গিয়ে নিজেই নিজের দাড়ি শেভ করেন। পরে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে রাতে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে জুট মিল ত্যাগ করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হেফজাতে এসব কথা বলেন তিনি। অন্যদিকে, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। পরে ‘ইসিজি’ করানোর পর তার হৃদরোগের বিষয়টি নিশ্চিত হন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
সালমানের বরাত দিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেক্সিমতো গ্রুপে কর্মরত নৌবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাকে নৌপথে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেন। সেই কর্মকর্তাই মোটা অঙ্কের টাকায় তাকে ম্যানেজ করে দেন একটি ইঞ্চিনচালিত ট্রলার। রাজধানীর ৩০০ ফুট সড়কের কাঞ্চন ব্রিজ এলাকা থেকে ওই ট্রলারে চড়েন সালমান।
সঙ্গে নেন স্যাটেলাইট ফোন, বিভিন্ন দেশের মুদ্রা, প্রয়োজনীয় সামগ্রী। সঙ্গী হিসেবে ডেকে নেন তার ঘনিষ্ঠজন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে। নৌযানটি চলে যায় সোজা ভোলায়। যাওয়ার সময় মাঝ পথ থেকে সঙ্গে নেওয়া হয় যাবতীয় খাদ্য ও জরুরি সামগ্রী। টানা সাত দিন বঙ্গোপসাগরে ভাসতে থাকেন তারা। সুযোগ খুঁজতে থাকেন মিয়ানমার পাড়ি দেওয়ার। মাঝখানে ভারতে পাড়ি দিতে সুন্দরবনের ভারত সীমান্তবর্তী এলাকার কাছাকাছি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তবে পরিস্থিতি সুবিধাজনক মনে না হওয়ায় নৌকার সারেং ফের ফিরে আসেন ভোলা এলাকায়। সিদ্ধান্ত নেন মিয়ানমার পাড়ি দেবেন। কোস্টগার্ড সদস্যরা শুরুতে সালমানকে চিনতে পারেননি বলে দাবি করেছেন সালমান। বলেছেন, শেভ করার পর তিনি নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলেন না। কোস্ট গার্ডের সদস্যরাও তাকে শুরুতে চিনতে পারছিলেন না। তারা প্রথমে আনিসুল হককে চিনে ফেলেন। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে আনিসুলই কোস্ট গার্ডের সদস্যদের সালমানকে চিনিয়ে দেন। তদন্ত সূত্র বলছে, আদালতের নির্দেশে ডিবি কার্যালয়ে এরই মধ্যে অনেক ভিআইপিকে নেওয়া হয়েছে। তবে আরও অনেকের রিমান্ড আদেশ আদালত দিয়েছেন। পর্যায়ক্রমে তাদের রিমান্ডে নেওয়া হবে। স্থান সংকুলানের কারণে তাদের এই মুহূর্তে নেওয়া হচ্ছে না। সূত্র আরও বলছে, ইসিজি রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকরা এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের অন্তত ৪/৫টি ব্লক থাকার বিষয়টি ধারণা করছেন। তবে গতকাল সকালে অসুস্থ হওয়ার আগে জিয়া দাবি করেছেন, গত ১২ জুলাই তিনি সরকারের উচ্চ পর্যায়কে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন সরকার আর টিকবে না। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোর কমিটি তার এই বার্তাকে আমলে নেয়নি। হাসিনা সরকারের পতনের জন্য মূলত দায়ী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সালমান এফ রহমান। গত নয় বছর আগে মুখের ওপর সত্য কথা বলার কারণে টানা চার মাস তাকে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ছাত্র আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করার সিদ্ধান্তও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়েছিলেন।
সালমানের বরাত দিয়ে তদন্ত সূত্র জানায়, এস আলমের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া দেড় লাখ কোটি টাকার অর্ধেকই শেখ রেহানা এবং সজীব ওয়াজেদ জয়কে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এসব অনিয়ম হয়। তবে এসব বিষয়ে কেউ ‘টু’ শব্দ করার সাহস করেনি। কেবলমাত্র অর্থ পাচার নয়, দেশের ইস্টার্ন রিফাইনারি, চিনিকল হাতিয়ে নিলেও এস আলমের বিষয়ে সবাই নীরব ছিলেন। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বলেছেন, ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে যারা অর্থ, পরামর্শ ও বক্তৃতা কিংবা বিবৃতি দিয়ে উৎসাহিত করেছেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। গ্রেফতার প্রায় সবাই নানাভাবে নিজেদের জড়িয়েছেন এমন অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, নিজের বান্ধবীর জামিন, নিয়োগ, বদলি এবং পদায়ন বাণিজ্যের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় সাবেক আইন মন্ত্রী আনিসুল হককে। শুরুর দিকে অস্বীকার করলেও এখন তিনি বলছেন, এর বেশির ভাগই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুরোধ ছিল। তবে মাঝেমধ্যে তৌফিকা হয়তো নিজেও কিছুটা করেছে। তবে তার পরিমাণ খুবই কম ছিল বলে দাবি তার। ঘুষের লেনদেন কোথায় হতো? এমন প্রশ্নের জবাবে নীরব থাকেন আনিসুল। প্রসঙ্গত, গত ১৩ আগস্ট রাজধানী ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে গ্রেফতার করা হয়।