খেলা তখন শতভাগ হেলে পড়েছে বাংলাদেশের দিকে। আবরার আহমেদ ওভারের শেষ বলটি হয়তো সেজন্যই একটু ফ্লাইট দিলেন। জয়ের জন্য ছটফট করতে থাকা সাকিব আল হাসান ভুল করেননি। উইকেট থেকে দুই কদম বেরিয়ে দুম করে উড়িয়ে মারেন। বল সীমানা দড়ি পার হতেই জয়োচ্ছ্বাসের একটা স্মিত হাসি দেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। জয়ানন্দে উপুড় হয়ে মাটিতে চুমু খান মুশফিকুর রহিম। সাকিব ও মুশফিক-বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুই সিনিয়র সিটিজেন। রাওয়ালপিন্ডিতে ৬ উইকেটে ঐতিহাসিক জয়ের পর দুই সিনিয়রের উচ্ছ্বাসভরা ছবিটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের এযাবৎকালের সেরা ছবিগুলোর অন্যতম। ছবিটি শুধু রাওয়ালপিন্ডি টেস্ট জয়ের নয়, পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশেরও। শুধু সাকিব-মুশফিক যুগলবন্দির ছবিটি নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সব ছবিই প্রাণে ভরা, উচ্ছ্বাসে ভরা, বাঁধভাঙা আনন্দের। দুই সাবেক অধিনায়ক যখন জয়োৎসব করছেন, তখন সাজঘরে অধিনায়ক নাজমুল শান্ত সিরিজ জয়ের আনন্দে হাত মেলাচ্ছেন কোচ চন্ডিকা হাথুরাসিংহে, বোলিং কোচ আন্দ্রে অ্যাডামস, ব্যাটিং কোচ জাস্টিন হেম্পসহ সব ক্রিকেটারের সঙ্গে। এরপর সব ক্রিকেটার একসঙ্গে মাঠে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতে সেলফি তুলে সোনালি ফ্রেমে বন্দি হন। গত ৭০ বছরে ঘরের মাটিতে দ্বিতীয়বারের মতো টেস্ট সিরিজে হোয়ইটওয়াশ হয়েছে পাকিস্তান। ২০২২ সালে ইংল্যান্ডের কাছে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল।
গতকালের ঐতিহাসিক জয়ে পাকিস্তানের মাটিতে এ প্রথম লাল-সবুজ পতাকার জয়জয়কার। রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম টেস্ট বাংলাদেশ জিতেছিল ১০ উইকেটে। ওই টেস্টের সেরা ক্রিকেটার হয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম। ৬ উইকেটে জয়ী টেস্টে চাপের মুখে অসাধারণ ব্যাটিং করে ম্যাচসেরা হয়েছেন লিটন দাস। সব মিলিয়ে সিরিজসেরা হয়েছেন স্পিন অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ। সিরিজে টাইগার ক্রিকেটারদের জয়জয়কারে ভরা।
নাজমুল শান্তর নেতৃত্বে পাকিস্তানের মাটিতে ২৩ বছরের ব্যবধানে প্রথমবার টেস্ট ও সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। বাংলাওয়াশ করল। কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের দুই যুগের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে স্মরণীয় জয়, সবচেয়ে বড় সিরিজ জয়। এখন পর্যন্ত টাইগাররা টেস্ট সিরিজ জিতেছে ৯টি। হোয়াইটওয়াশ করেছে ৪টি। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়টি ছাড়িয়ে গেছে সবকটিকে। বাংলাদেশ টেস্ট সিরিজ জিতেছে জিম্বাবুয়ে (৪), ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২) এবং আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বিপক্ষে। টাইগাররা হোয়াইটওয়াশ করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুবার (২০০৯ ও ২০১৮-১৯)। দুবারের ব্যবধান ২-০, জিম্বাবুয়েকে একবার (২০১৪-১৫), ব্যবধান ৩-০। এবার পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় ২-০ ব্যবধানে। সব মিলিয়ে ১৪৪ টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশের এটা ২১তম জয়।
বাংলাদেশ এর আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছে হাতেগোনা একটি-দুটি। এবার শুধু চোখে চোখ রেখে লড়াই-ই করেনি, দাপুটে ক্রিকেট খেলে টেস্ট দুটিকে একপেশে করেছে। প্রথম টেস্টে বৃষ্টিবাধার পরও অবিশ্বাস্য ক্রিকেট খেলেছে টাইগাররা। বৃষ্টিবাধায় দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিন ভেসে যায়। পরের দুই দিন খেলা হলেও চতুর্থ দিন ফের বৃষ্টি বাধা হয়। ভেসে যায় ৪৬ ওভার। পঞ্চম ও শেষ দিনেও বৃষ্টি চোখ রাঙাচ্ছিল। সেজন্যই হয়তো চতুর্থ দিনে ১৮৫ রানের টার্গেট টপকে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের আনন্দে ভাসতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সময় বেশি লাগলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের জয়ে বাধা হতে পারেনি বৃষ্টি। নাজমুল বাহিনী হেসেছে জয়ের আনন্দে। হেসেছে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়ের বিরল সাক্ষী হয়েছে।
প্রথম দিন খেলা হয়নি বৃষ্টিতে। দ্বিতীয় দিন সিরিজসেরা মিরাজের আগুনে ঘূর্ণি এক দিনেই পাকিস্তানকে অলআউট করেছে ২৭৪ রানে। মিরাজ উইকেট নেন ৫টি। তাসকিন আহমেদ ৩টি। তৃতীয় দিন প্রথম সেশনে ২৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সেখান থেকে ১৩৮ রানের অতিমানবীয় ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরান লিটন দাস। ইনিংসটি খেলে ম্যাচসেরাও হয়েছেন। অবশ্য ৭৮ রানের প্রত্যয়ী ইনিংস খেলেন মেহেদী মিরাজ। আগের টেস্টে খেলেছিলেন ৭৭ রানের ইনিংস। দুই টেস্টে ১০ উইকেট ও ১৫৫ রান করে সিরিজসেরা হয়েছেন মিরাজ। প্রথম টেস্টে ১৯১ রান করে ম্যাচসেরা হয়েছেন মুশফিক। লিটন দ্বিতীয় টেস্টে ১৩৮ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা হয়েছেন। ১২ রানে এগিয়ে থেকেও দ্বিতীয় ইনিংসে স্বাগতিকরা টাইগার তিন পেসার হাসান মাহমুদ, নাহিদ রানা ও তাসকিনের গতি, সুইং ও বাউন্সে অসহায় হয়ে পড়ে। গুটিয়ে যায় ১৭২ রানে। ১৪৪ টেস্ট ইতিহাসে এ প্রথম প্রতিপক্ষের কোনো ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়ে ইতিহাস গড়েন তিন পেসার। পাকিস্তান সিরিজ শেষ। পাকিস্তানকে প্রথমবারের মতো বাংলাওয়াশ করে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ৪ নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে দুই টেস্ট ও তিন টি-২০ খেলবে টাইগাররা। এখন সেদিকেই চোখ টাইগার অধিনায়ক নাজমুল শান্তর। দুই দলে ভাগ হয়ে আজ ও কাল দেশে ফিরবেন ক্রিকেটাররা।