দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সরকারের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আমরা একযোগে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। সরকার এবং সরকারের বাইরে যারা আছেন সবাই একজোট। এক টিম। এটা একটা কমপ্যাক্ট টিম। আপনারা সেই টিমের মেম্বার। যতটুকু সময় আমরা দায়িত্বে আছি একটা টিম হিসেবে কাজ করতে চাই। গতকাল রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ন্যাশনাল বিজনেস ডায়ালগে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ (আইসিসিবি) এ ডায়ালগের আয়োজন করে।
আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমানের পক্ষে অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য দেন সংগঠনের নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর নাসির হোসেন। আরও বক্তব্য দেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
প্রধান উপদেষ্টা নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য সমর্থন চেয়ে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, উৎপাদনশীলতা, সক্ষমতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে এক টিম হিসেবে কাজ করলে বিশ্ববাজারে কার্যকরভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারবে বাংলাদেশ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমার সামনে যারা বসে আছেন, আপনারা সবাই বিশ্বমানের উদ্যোক্তা। অতীতের পচনশীল দেশ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে সহায়তা চান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, যতটুকু সময় আমরা সরকারে আছি, ততটুকু সময়ই আমরা টিম হিসেবে কাজ করব। সবাই মিলে তরুণদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব। তরুণরা যদি সুযোগ না করে দিত, তাহলে জাতিকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করা যেত না। এজন্য আমাদের সুস্থ-সমৃদ্ধ দেশ হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের নতুনভাবে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা এটা যেন হারিয়ে না ফেলি। আর যদি হারিয়ে ফেলি তাহলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সব বিষয় আমরা জানি না; কিন্তু একযোগে কাজ করলে অভিজ্ঞতা হবে। স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ফলে আমাদের অনেক সুযোগসুবিধা হারাতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী ইউরোপ-আমেরিকায় আছে, তাদের কাছে আমাদের ফরিয়াদ আমাদের আপনারা সমর্থন দিন। তিনি বলেন, আমার এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লুৎফে সিদ্দিক ব্যবসায়ীদের কথা শুনবেন। তার মাধ্যমে আপনারা সবকিছু আমাকে জানাতে পারবেন। শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা এ অঙ্গীকার করলাম। সংস্কার শুধু সরকারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে সবাই মিলে করার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। যেটা না করলে দেশের জন্য ভালো হয়, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার আহবানও জানান তিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যে সময়টা আমরা সরকারে থাকব শ্রমিক-মালিক-সরকার সম্পর্কটা সুন্দরভাবে গড়ে তুলব। এটা না করলে সামনে এগোনো কষ্ট হবে। আপনারা সাহস দেন, এগিয়ে আসেন সবাই মিলে আইএলও সনদে স্বাক্ষর করে ফেলব। সামাজিক ব্যবসা করতে ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকারের ওপর ভরসা না করে আপনাদের ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলায় বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিশ্চিত করতে সামাজিক ব্যবসা করুন। যেখানে আপনাদের শিল্পকারখানা সেখানেও করতে পারেন।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতি থেমে ছিল, আমরা টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি। ব্যবসার বাধাগুলো দূর করার চেষ্টা করছি। পুঁজিবাজার অনেক অবহেলিত। দেশে ডিমের দাম অতিরিক্ত। বগুড়ার ১০ টাকার বেগুন কেন ঢাকায় ১০০ টাকা দিয়ে কিনতে হবে? এগুলো মনিটরিংয়ে বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে আরও প্রতিনিধিত্বশীল হতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে মানুষের জন্য কাজ করার আহ্বান জানান উপদেষ্টা।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, স্বল্প মজুরি এবং দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর করে খুব বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারব না। প্রকৃত ব্যবসায়ীরাই দেশের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন। কিছু ব্যবসায়ী বিগত সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে রাতারাতি বিলিয়নিয়র হয়েছেন। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা নানা কারণে নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হন।
মূল বক্তব্যে মীর নাসির হোসেন বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর অসৎ চর্চা এবং আর্থিক অনিয়মের কারণে দেশের অর্থনীতি আজ হুমকির মুখে। ব্যবসায়ীদের পক্ষে আমি সব অসাধু ব্যবসায়ী ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জোরালো আবেদন জানাচ্ছি। যারা সৎভাবে ব্যবসা করছেন তাদের নিরাপদে ও আস্থার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেন তিনি। মীর নাসির হোসেন বলেন, ১০০টির বেশি কারখানা ভাঙচুর করায়, ২০০-এর বেশি কারখানা বন্ধ রাখায় ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আইনের অস্বচ্ছতার কারণে দেশের মানুষের জীবনের বিনা বিমায় বাণিজ্যিক ও অন্যান্য মোটরযান রাস্তায় চলাচল করছে। তাই বিমাশিল্পের সংস্কার একান্ত জরুরি। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কারের কথা শুনছি। এ সংস্কার প্রক্রিয়া সর্বজনীন হওয়া উচিত। ব্যবসায়ীরাও সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানে আগ্রহী। বেশ কিছু দেশ বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা জারি করেছে; যা বিদেশি বিনিয়োগকারী, ক্রেতাদের আস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে ভ্রমণ সতর্কতা তুলে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। মীর নাসির বলেন, আমাদের বিপুলসংখ্যক তরুণ জনশক্তি রয়েছে। তারাই দেশের ভবিষ্যৎ। এ যুবসমাজের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির জন্য বেসরকারি খাতকে আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায় সংস্কৃতির সামগ্রিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে দেশের ব্যবসায়ীসমাজের মধ্যে দায়িত্বশীল ব্যবসা পরিচালনার নতুন অধ্যায় সূচনা করতে আগ্রহী।
সংলাপে এফবিসিসিআই, ঢাকা চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বার, চট্টগ্রাম চেম্বার, ফরেন চেম্বার, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএ, ফার্মাসিউটিক্যালস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন পাবলিক লিস্টেড কোম্পানিজ, বেসিস ও লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিরা অংশ নেন।