বাবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও ছেলে শাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতির পরামর্শেই চলত মন্ত্রণালয়। বাবার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে হাতিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। দেশে-বিদেশে গড়েছেন সম্পত্তির পাহাড়। দখল, চাঁদাবাজি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতি বাণিজ্যের সবকিছুই ঠিক করে দিত ‘জ্যোতি সিন্ডিকেট’। আর এসব কাজ করতে রাজধানীতে ছিল একাধিক অফিস। সেসব অফিসে পুলিশ কর্মকর্তার ভিড় লেগেই থাকত। তাঁরা যেতেন বদলি-পদোন্নতির তদবির নিয়ে। আর এ জ্যোতি সিন্ডিকেটেই ছিলেন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আজিজুল হক রানা, সৈয়দ মিজান ও সুজন ঢালী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে লুটপাটে জ্যোতি ছড়িয়েছেন কামালপুত্র জ্যোতি। গত শুক্রবার রাতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলে জ্যোতিকে গ্রেপ্তারের পর চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। ১১ সেপ্টেম্বর আশুলিয়া থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মো. রবিউল সানির মামলায় ৪ নম্বর আসামি শাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতিকে শুক্রবার মধ্যরাতে বনানী থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩০ জনকে আসামি করা হয়। জানা গেছে, ক্ষমতায় থাকাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি মুখে মুখে থাকলেও কেউ ‘টুঁ’শব্দ করার সাহস পাননি। তবে শুক্রবার রাতে জ্যোতিকে গ্রেপ্তারের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা। দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে শাফি মুদ্দাসিরকে মেসার্স তিতাস বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নামে একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানিয়ে রাখেন তাঁর বাবা আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ প্রতিষ্ঠানের নামেই চলত বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি। টেকনাফের মিঠাপানির ছড়ার ১ নম্বর প্লটে ৫ দশমিক ৫০৬৪ একর জমি কেনা হয়। তা ছাড়া লেঙ্গুরবিল মৌজায় একই কোম্পানির নামে কেনা জমির মূল্য প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অমোছনীয় কালি কিনতে শুধু ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যায় করে শাফি মুদ্দাসির সিন্ডিকেট। এ ছাড়া আরও ৬ কোটি টাকার অমোছনীয় কালি কেনে নির্বাচন কমিশন। যার টেন্ডার বাগিয়ে নেয় শাফি ও নির্বাচন কমিশনের সচিব জাহাঙ্গির আলমের আত্মীয়ের যৌথ সিন্ডিকেট। দুর্নীতিগ্রস্ত আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তাঁর ছেলে শাফি মুদ্দাসিরের লুটপাট হাসিনা সরকারের আমলে চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।
জানা যায়, নির্বাচন কমিশনের অমোছনীয় কালি কেনার টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছিলেন কামালপুত্র জ্যোতি। সে সময় গণমাধ্যমকর্মীরা বিষয়টি আঁচ করতে পারলেও প্রকাশ করার সাহস করেননি। একটি শীর্ষ গণমাধ্যম এ নিয়ে প্রতিবেদন করলেও তাতে শাফি মুদ্দাসিরের নাম উল্লেখ করেনি। যেখানে সর্বনিম্ন দরদাতা টেন্ডার পায়, সেখানে সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়ার পরও কালি কেনার কাজটি পান শাফি ও তাঁর সিন্ডিকেট।
অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর পুরো ধানমন্ডি এলাকায় ছিল তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। ধানমন্ডি রেস্টুরেন্ট দেওয়ার জন্য শাফি মুদ্দাসির জ্যোতিকে দিতে হতো ১ থেকে ২ কোটি টাকা। টাকা দিলে কোনোরকম যাচাইবাছাই ছাড়াই মিলত লাইসেন্স। আর লাইসেন্স করতে বাবার প্রভাব খাটাতেন জ্যোতি। শুধু তাই নয়, এসব রেস্টুরেন্ট থেকে যেসব চাঁদা নেওয়া হতো তা-ও এক হাতে সামলাতেন জ্যোতি।
শুধু রাজধানীর কারওয়ান বাজার এবং মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকেই প্রতিদিন দেড় কোটি চাঁদা উঠত। এর বড় অংশ চলে যেত জ্যোতির পকেটে। এর বাইরে রাজধানীর প্রায় সব ফুটপাত, বাজার, মাদক কারবার ও আবাসিক হোটেল থেকে ওঠানো চাঁদার বড় একটি অংশ চলে যেত জ্যোতির কাছে। এ টাকা তাঁদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব ছিল মন্ত্রীর এপিএস মনির হোসেনসহ আরও দুজনের। জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংস্থাগুলোয় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল জ্যোতির। এ বিষয়টি তাঁর পক্ষ থেকে দেখভাল করতেন তাঁর বন্ধু খ্যাত ২৯ বিসিএসের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী। আশুলিয়া থানার মামলায় কাফী গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। দেশব্যাপী ২০০ থানায় ওসি নিয়োগে অন্তত ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় জ্যোতি সিন্ডিকেট। দেশে এবং বিদেশে পুলিশে নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, আসামি ছেড়ে দেওয়ার সবকিছুই দেখভাল করতেন কাফী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস মনির। তবে কারাগার, ফায়ার সার্ভিস, মাদক ও আনসারের বিষয়টি দেখতেন মনির। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব টেন্ডারে মোটা অঙ্কের ভাগ পেতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল। অর্থের বড় একটি অংশ ইউরোপে লেনদেন হতো। জার্মানিতে নিজের নামে বাড়িও গড়েছেন জ্যোতি। সীমান্তে চোরাচালান এবং গরুর খাটাল নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ মিজান ও আজিজুল হক রানা। নিকেতনে ও ফার্মগেটে তাঁর নিজের অফিস থেকেই সব অপকর্ম বাস্তবায়ন করতেন। তবে সুন্দরী রমণীদের নিয়ে মাঝে মাঝেই জ্যোতি চলে যেতেন সাভারে অটো ব্রিক ফিল্ডে। সব ধরনের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা রাখা হতো আগে থেকেই।