বিএনপি নেতা শামা ওবায়েদ বলেছেন, দেশের বর্তমান সংকটের শতকরা ৮০ ভাগ সমাধান হয়ে যাবে যদি রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়। গত ১৫ বছর স্বৈরাচার শাসনামলে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার অভাব ছিল। যে যার ইচ্ছামতো লুটপাট করেছে। লুটপাটের সুযোগকে বৈধতাও দেওয়া হয়েছে যাতে স্বৈরাচার ক্ষমতায় থাকতে পারে। তিনি বলেন, প্রত্যেক রাজনীতিবিদকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। প্রত্যাশা করি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের লক্ষ্যে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তার রূপরেখা জাতির কাছে তুলে ধরবে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় বিএনপির আগামী দিনের রাজনীতি, দেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়েও খোলামেলা কথা বলেন এই বিএনপি নেত্রী। শামা ওবায়েদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতির ধরন পরিবর্তন হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম একশন চায়। কথার ফুলঝুরি শুনতে চায় না। তারা কাজ এবং রেজাল্ট দেখতে চায়। শুধু রেজাল্ট নয়, প্র্যাকটিকাল রেজাল্ট দেখতে চায়। বললাম একটা, করলাম আরেকটা আর আমার রেজাল্ট হলো আরেকটা- এ ধরনের বাংলাদেশ নতুন প্রজন্ম দেখতে চায় না। তিনি বলেন, প্রত্যেক রাজনীতিবিদকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যারা নির্বাচন করবে তাদের প্রতিটি কর্মকান্ডকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। জাতীয় সংসদকে একটি প্রকৃত জবাবদিহিতামূলক সংসদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সে জন্যই বিএনপি বার বার করে বলছে, দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে না। ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একজনের হাতে এত ক্ষমতা দিলে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে না। শামা ওবায়েদ আরও বলেন, অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানেও স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। একটা পরিবার সব দখল করে রাখবে বা একটা লোক ১০টা ব্যাংক দখল করে রাখবে, ঋণ নিয়ে ফেরত দেবে না, পালিয়ে যাবে- এসব রোধ করা সম্ভব যদি এই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা যায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিএনপির প্রত্যাশা কী জানতে চাইলে শামা ওবায়েদ বলেন, ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের সবার প্রত্যাশাই অনেক বেশি। হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার ফলে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি সেক্টর তার স্বাভাবিক রূপ হারিয়েছে। অর্থনীতি, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, দুদকসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তাদের স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে আনতে হবে। সংবিধান সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোও করতে হবে।
শামা ওবায়েদ বলেন, তবে অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু স্বল্প সময়ের জন্য গঠিত হয়েছে, তাদের পক্ষে এতগুলো কাজ শেষ করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। এ জন্য প্রয়োজন জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে শেষ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, গত ১৫ বছরে যেসব ব্যক্তি ও পরিবার গুম, খুন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের প্রাপ্য ন্যায়বিচার দিতে হবে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি কমিশনও গঠন করা হয়েছে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে হাত দেওয়ার আগে স্বচ্ছ তদন্তের ভিত্তিতে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার কাজটিও জরুরি। বিএনপির এই নেত্রী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। ১৫ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করার কাজটি মোটেই সহজ নয়। অন্তর্বর্তী সরকার এই কাজ সম্পূর্ণ করতে যতটুকু সময় প্রয়োজন সেটুকু তারা নেবেন। একইসঙ্গে একটি দেশকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে একটি গণতান্ত্রিক ও জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারেরও প্রয়োজন। আমাদের প্রত্যাশা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে কাজ করতে অন্তর্বর্তী সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে তার একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তারা জাতির সামনে তুলে ধরবে। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এজন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে যে ধরনের সহযোগিতা চাইবে আমরা তা দিতে প্রস্তুত আছি। শামা ওবায়েদ বলেন, সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে দেড় বছর আগে রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা ঘোষণা করেছিল বিএনপি। এই ৩১ দফায় রাষ্ট্র মেরামতের প্রায় সব দিকই তুলে ধরা হয়েছে। এই ৩১ দফা থেকে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন রাষ্ট্র সংস্কারের অনেক ধারণাও পেতে পারে। ‘নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে কি কোনো দূরত্ব লক্ষ্য করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ভাবনা এবং মৌলিক চিন্তাধারা থাকে। ফলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একেকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা একেক রকমের বক্তব্য দেবেন এটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ দেখছি না। এমনকি একটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন ইস্যুতে নেতা-কর্মীদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হতে পারে, এতে অস্বাভাবিকতার কোনো বিষয় নেই। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত- জানতে চাইলে শামা ওবায়েদ বলেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বিএনপির পররাষ্ট্র নীতি অত্যন্ত পরিষ্কার। সবার সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক থাকবে। তবে সেটি হবে সমতা, ন্যায্যতা এবং পারস্পরিক স্বার্থগুলোর অক্ষুণœতার ভিত্তিতে।
বিভিন্ন মহল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দল। আমরা চাই না কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হোক। তবে আওয়ামী লীগের (নেতা-কর্মী) বিরুদ্ধে যেসব হত্যাযজ্ঞ, দুর্নীতি, অন্যায়, অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে তার বিচার হওয়া জরুরি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে সরাসরি জড়িত থেকে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন। বিভিন্ন সময় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে তার সরাসরি জড়িত থাকার যে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তাতে বাংলাদেশের একজন নাগরিক ও রাজনীতিক হিসেবে অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে বিএনপি এখন কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে- জানতে চাইলে শামা ওবায়েদ বলেন, কেউ ১ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করে দেবে আর কেউ দুই বেলা খেতে পারবে না, এ ধরনের বৈষম্যের রাজনীতিতে বিএনপি বিশ্বাস করে না। সবাই তার মেধা অনুযায়ী চাকরি পাবে। প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবসা করার সুযোগ পাবে। অর্থাৎ সবার জন্য একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করাটাই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের ফলে বিএনপির ছোট-বড় প্রত্যেক নেতা-কর্মী হয়রানির শিকার হয়েছেন। এত কিছুর পরও বিএনপি ইতিবাচক রাজনীতির দিকে এগোচ্ছে। এত নির্যাতনের শিকার হয়েও বিএনপির তৃণমূল দেশের প্রতি, দলের প্রতি অনেক বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং নিবেদিতপ্রাণ। সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে দেশে ইতিবাচক রাজনীতির ধারা অব্যাহত রাখতে বিএনপি কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সংবিধানের কিছু কিছু ধারা সংস্কারের কথা বলেছি। প্রস্তাবনা জানিয়েছি জাতীয় সরকার গঠনের। বিএনপি যদি সরকার গঠনের সুযোগ পায় তাহলে সবাইকে নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে চায়। ছাত্র-জনতার মেধাকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি বাংলাদেশকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চায়।
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা প্রসঙ্গে শামা ওবায়েদ বলেন, আমরা দলীয় নেতা-কর্মীরা এবং সর্বোপরি দেশের মানুষও চাইছি তিনি দেশের মানুষের পাশে থেকে দেশের জন্য কাজ করুন। দেশের বাইরে থাকলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দল এবং দেশের স্বার্থে এতদিন কাজ করেছেন, এখনো করছেন। অত্যন্ত সফল একটি আন্দোলনের নেতৃত্ব তিনি এতদিন ধরে দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকার যেসব মিথ্যা মামলা দিয়েছে আমি মনে করে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে একটা উপযুক্ত সময়ে উনি দেশে ফিরবেন।
বিএনপির বর্তমান সাংগঠনিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শামা ওবায়েদ বলেন, বিগত বছরগুলোতে প্রশাসন এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের চাপের মুখে বিভিন্ন বিভাগ এবং জেলায় আমাদের নেতা-কর্মীরা তাদের কোনো কার্যক্রম চালাতে পারেননি। এখন দলের স্বাভাবিক সাংগঠনিক কর্মকান্ড চলমান রয়েছে। যদিও আমার দলীয় সাংগঠনিক পদ বিভিন্ন কারণে স্থগিত রয়েছে। তারপরও আমি আমার জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছি। দলীয় পদ স্থগিত হওয়ার পেছনে কারণ কী ছিল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমার জন্য দুঃখজনক। আমার বাবার নির্বাচনি এলাকা ফরিদপুরে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন পাঁচজন মৃত্যুবরণ করেছেন, অনেকে আহত হয়েছেন। যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে সেই ঘটনার সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর উৎসবমুখর পরিস্থিতির মধ্যে যুবলীগের কিছু নেতা-কর্মী সেখানে শো ডাউন করেছে, যা এলাকার মানুষের পছন্দ হয়নি। সম্ভবত সেখান থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। এ ঘটনায় একজন মারাও গেছেন। মৃত ব্যক্তি যে দলেরই হোক এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এর তদন্ত হওয়া উচিত। আমার বিষয়ে দল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমি সেটিকে সঠিক মনে করি। একটি দল পরিচালনা করতে গেলে অবশ্যই শৃঙ্খলাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তদন্ত হলেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে। এতে আমার কোনো সমস্যা নেই।