৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবির মামলায় গ্রেপ্তার রংধনু গ্রুপের পরিচালক ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলী হায়দারের আদালত শুনানি শেষে রিমান্ডের আদেশ দেন। এদিকে রূপগঞ্জে জমি দখল ও দখলবাণিজ্য কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডে জড়িত গ্রেপ্তার মিজানুর রহমান ওরফে মিজানের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী। তারা জানান, রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের দখলবাণিজ্যের গুন্ডাবাহিনীর প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন মিজান। তাই মিজানের পাশাপাশি রফিকের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবি জানাচ্ছি। গতকাল সকালে ‘রূপগঞ্জের সর্বস্তরের জনগণ’ ব্যানারে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় হিন্দু সম্প্রদায়সহ ভুক্তভোগী পরিবারের শতাধিক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। বিচার চাইতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত শিশু স্বাধীনের নানা রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘আমার নাতি হত্যার বিচার চাই। জায়গাজমির জন্য তারা আমার নাতিরে মাইরা ফালাইছে। ১০ মাস হলো আমার নাতি আমাকে নানা বলে ডাকে না। আমার গলা জড়ায়ে ধরে এখন আর কেউ ঘুমায় না। টাকার অভাবে আমি মামলাও করতে পারিনি। আমি জায়গা-টায়গা কিছুই চাই না, শুধু আমার নাতিকে চাই।’ নিহত স্বাধীনের বাবা শাহীন আলম বলেন, ‘জমির জন্য আমার ছেলেকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। গত বছর ১৫ ডিসেম্বর খিলগাঁও থানায় মামলা করতে গিয়েছি। থানার ওসি জানিয়েছে রফিক-মিজানের নাম বাদ দিলে মামলা নেবে। প্রশাসনের কোথাও গিয়ে আমরা সুষ্ঠু বিচার পাইনি। রফিক-মিজান ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। আমি একমাত্র সন্তানের হত্যার বিচার চাই।’ নিহত স্বাধীনের মা উম্মে হানি মুন্নী বলেন, ‘প্রথম শ্রেণি পাস করে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠেছিল স্বাধীন। কিন্তু রফিক-মিজানের গুন্ডাবাহিনী আমার ছেলেকে অনেক কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলেছে। আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।’ নিহত দ্বীন ইসলামের মা ঝর্ণা বলেন, ‘জমি দখলের জন্য আ া রফিকের হয়ে সন্ত্রাসী মিজান, শফিক ও জসু আমার একমাত্র ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমার ছেলে এসএসসি পাস করছিল। একমাত্র সন্তান দ্বীন ইসলামই ছিল আমার আশাভরসা। কিন্তু ওরা আমার ছেলেকে বাঁচতে দেয়নি। বাসায় এসে তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাড়িঘর ভেঙে ফেলেছে। লুটপাট করে আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। ওরা আমাকে কেন মেরে ফেলে নাই? দারোগার কাছে বিচার দিয়াও কোনো লাভ হয় নাই। আমি গরিব মানুষ। আমি কোনো দল করি না। আমি এটার তদন্ত চাই, খুনিদের ফাঁসি চাই। এর বেশি আমি আর কোনো কিছু চাই না। ওগো জ্বালায় আমরা কেউ শান্তিতে থাকতে পারি না।’ নিহত দ্বীন ইসলামের নানা আজিজ উল্লাহ বলেন, ‘রফিক-মিজানরা আমাদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলেছে। আমার নাতিকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো হয়রানির শিকার হয়েছি। মিজান গ্রেপ্তার হয়েছে। রফিকেরও গ্রেপ্তার দাবি করছি। আমার নাতি হত্যার বিচার চাই।’ ভুক্তভোগী সাজেদুল ইসলাম সোহাগ বলেন, ‘আমার ৪২ লাখ টাকা ও আমার ভাই নয়নের ৮৫ লাখ টাকা নিয়েছে রফিক-মিজান। মানুষের জমিগুলো তারা জোর করে দখল করে নিত। জমির মালিককে পাওনা না দিয়েই পুকুর-আবাদি জমি বালু ফেলে ভরাট করে নিত। আ া রফিকের গুন্ডাবাহিনী হয়ে মিজান এসব কাজ করত। এখনো জমিগুলো উদ্ধার হয়নি। তাদের ৪০০-৫০০ জনের গুন্ডা বাহিনী আছে। এখনো তাদের দখলবাণিজ্য চলছে। আমাদের এলাকার অন্তত ২০০-৩০০ বাড়ির মানুষ ভুক্তভোগী। মিজান আটক হয়েছে, আমাদের দাবি, তার ফাঁসির রায়ের পাশাপাশি আ া রফিককে গ্রেপ্তার করা হোক।’
ভুক্তভোগী আনন্দ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘জায়গাজমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য রফিক-মিজান ও তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী আমাদের অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখাত। তারা আমাদের জায়গাজমি দখল করে নিয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন বাড়িঘরছাড়া। আমরা জায়গাজমি ফেরত চাই। রফিক-মিজানের বিচার চাই।’ ভুক্তভোগী হাজি মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘রফিক-মিজান আমার তিন তলা বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমার ৯৫ শতাংশ জমি দখল করেছে। আমি তাদের বিচার চাই।’ মানববন্ধনে ভুক্তভোগীদের হাতে ‘বেনজীরের ক্যাশিয়ার আ া রফিকের ফাঁসি চাই’, ‘বেনজীরের ক্যাশিয়ার কুত্তা মিজানের ফাঁসি চাই’, ‘রূপগঞ্জের কসাই আ া রফিকের ফাঁসি চাই’, ‘অসংখ্য মায়ের বুক খালি করা খুনি রফিকের ফাঁসি চাই’, ‘স্বাধীন হত্যার বিচার চাই’, ‘ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার চাই’ লেখা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড দেখা যায়।
আদালত প্রতিবেদক জানান, খিলক্ষেত থানার মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া রংধনু গ্রুপের পরিচালক ও রূপগঞ্জ উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খিলক্ষেত থানার পরিদর্শক মো. আশিকুর রহমান দেওয়ান ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করে। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে দুই দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
গত ৩০ এপ্রিল মাহবুব রহমান মিধু বাদী হয়ে রংধনু গ্রুপের রফিকুল ইসলামসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে খিলক্ষেত থানায় মামলা করেন। মিজানুর এ মামলার ৪ নম্বর এজাহারনামীয় আসামি। মঙ্গলবার ভাটারা থানার যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ২৮ এপ্রিল রাত সাড়ে ১১টায় দেশি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেআইনি জনতাবদ্ধে রফিকুল ইসলামের নির্দেশে মেসার্স ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও সিটি মাল্টি এগ্রিকালচারাল কোম্পানির সম্পত্তিতে অনধিকার প্রবেশ করেন। সম্পত্তিতে থাকা সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তির সাইনবোর্ড ভাঙচুর করেন ও কেটে চুরি করে নিয়ে যান। এ সময় কোম্পানির সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা তিনজন নিরাপত্তাকর্মী বাধা দিলে আসামিরা এলোপাতাড়ি কিলঘুসি মেরে তাদের আহত করেন। আসামি কাউসার আহমেদ অপু মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ভাঙচুর করেন। এ সময় আসামিরা হুমকি দিয়ে বলেন এ সম্পত্তির মালিক তারা। যদি এ সম্পত্তি দখলে রাখতে চাস তাহলে তোদের বসকে বলবি ৫ কোটি টাকা চাঁদা দিতে হবে। যদি চাঁদা না দেয় তাহলে ভবিষ্যতে আরও লোকজন নিয়ে এসে এ সম্পত্তি দখল করে নেব এবং যে বাধা দেবে তাকেই মেরে লাশ গুম করে ফেলব। আসামিরা কোম্পানির সম্পত্তিতে থাকা সাইনবোর্ড ভেঙে চুরি করে নিয়ে ২ লাখ টাকার ক্ষতিসাধন করেন।