দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা আরও গভীর করতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সহযোগিতা আরও শক্তিশালী ও সুসংহত করতে চায় দেশটি। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসা করে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতাও দেবে দেশটি। গতকাল নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। বৈঠকের পর এ কথা জানানো হয়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের মধ্যাহ্নভোজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মার্কিন ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এ ছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় বাংলাদেশ শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন, গুম-খুন ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকা , মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানান ড. ইউনূস। একই সঙ্গে বাংলাদেশের নানা সংস্কার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের সহায়তা কামনা করেন ড. ইউনূস। এ সময় মহাসচিব বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনা, খুন, গুম ও হত্যাকাে র বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে। জাতিসংঘ এ বিষয়ে সর্বাত্মক সহায়তা দিচ্ছে বলে জানান গুতেরেস।
নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। এ সময় ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে এ কথা জানানো হয়েছে।
কূটনৈতিকসূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘ সদর দপ্তরের নির্ধারিত সভাস্থলে গতকাল সকালে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় আধা ঘণ্টার বৈঠকে বাংলাদেশে কোন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে সে পরিস্থিতি তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা কামনা করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক্স হ্যান্ডলে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ড. ইউনূসের সঙ্গে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সহযোগিতা আরও গভীরতর করার প্রসঙ্গটি আলোচনায় এসেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বলা হয়েছে, ড. ইউনূসের সঙ্গে ব্লিঙ্কেনের বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রোহিঙ্গা সংকট, সন্ত্রাস দমন, শ্রমবিষয়ক সংকট, পাচার অর্থ পুনরুদ্ধারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর আগে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে মঙ্গলবার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় তিনি এ আহ্বান জানান।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের সতর্ক হতে হবে। এ সংকটের সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চল সমস্যায় পড়বে। তাই আমাদের অবশ্যই এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন করে ভাবার প্রস্তাব দেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রথমত আমরা চাই জাতিসংঘ মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সব পক্ষের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করুন। সম্মেলনে সংকটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নতুন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমাধানের উপায় কী হতে পারে, তেমন প্রস্তাব আসতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যকার বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময় পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারে সহায়তা চাওয়া হয়। এ সময় ব্লিঙ্কেন পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের ক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন। প্রধান উপদেষ্টা ও ব্লিঙ্কেন দুই দেশের সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে একমত হন। বাংলাদেশের জনগণের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ড. ইউনূসের দৃঢ়সংকল্প ও নেতৃত্বের জন্য ব্লিঙ্কেন তাঁকে সাধুবাদ জানান।
মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ
এদিকে নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বুধবার সেখানকার একটি হোটেলে শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তিনি বলেন তাঁর সরকার দেশে মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বৈঠকে জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থান এবং শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের সময় সংঘটিত নৃশংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার ও জবাবদিহি নিয়ে আলোচনা হয়। মানবাধিকার কর্মকর্তারা স্বৈরশাসকের সময় সংঘটিত প্রায় ৩ হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাে র অধিকতর তদন্তের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তাঁরা নিরাপত্তা খাতের সংস্কার, সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার ও নির্বিঘ্নে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এবং শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনামলে বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের ‘আটক কেন্দ্রে’র কার্যক্রমের জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। রবার্ট এফ কেনেডি মানবাধিকার সংগঠনের সভাপতি কেরি কেনেডি নয়জন মানবাধিকার কর্মকর্তার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ডও বৈঠকে যোগ দেন।
ক্যালামার্ড বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ‘একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠানো যে, এটি এক নতুন বাংলাদেশ। প্রফেসর ইউনূস কীভাবে আগের স্বৈরাচার শাসনামলে নাগরিকের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার হরণ করা হয়েছিল এবং তাঁর সরকার দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এ পর্যন্ত কী করেছে, তা সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের জন্য তাঁর সরকার পুলিশ সংস্কারসংক্রান্ত একটি কমিশনসহ বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার তার কর্মকাে র যে কোনো সমালোচনাকে স্বাগত জানাবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন বাকস্বাধীনতা বজায় রাখবে বলে অঙ্গীকার করেন। ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘এ সরকার কোনো সমালোচনায় বিচলিত নয়। আসলে আমরা সমালোচনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সরকার দেশে কারও কণ্ঠ রোধ করবে না।’ হংকংভিত্তিক সাবেক মানবাধিকারকর্মী মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্লেকনারও বৈঠকে বক্তৃতা করেন।