বিশ্ব ক্রিকেটে এক অনন্য নাম সাকিব আল হাসান। খ্যাতি হিসেবে পেয়েছেন অলরাউন্ডার উপাধি। দর্শকের ভালোবাসা পেলেও খেলাধুলার বাইরে বিভিন্ন কারণে হয়েছেন সমালোচিত। ব্যবসাবাণিজ্য করতে গিয়ে জড়িয়েছেন নানা কেলেঙ্কারিতে। শেয়ার কারসাজি, সোনা চোরাচালান, নিষিদ্ধ জুয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, ক্রিকেটে দুর্নীতি, ম্যাচ পাতানোর তথ্য গোপন করে নিষিদ্ধ হওয়া, নির্বাচনি হলফনামায় তথ্য গোপনসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে।
সবশেষ রাজনীতিতে জড়িয়ে হয়েছিলেন সংসদ সদস্য। হতে হয়েছে হত্যা মামলার আসামি। এবার আলোচনায় এসেছেন শেয়ার কারসাজিতে ৫০ লাখ টাকা জরিামানার মুখে পড়ে। প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার কারসাজির ঘটনায় সাকিব আল হাসান এবং তার অন্যতম ব্যবসায়িক পার্টনার আবুল খায়ের হিরুসহ চার ব্যক্তি ও তিন প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
এর মধ্যে সাকিবকে ৫০ লাখ টাকা, সাকিবের অন্যতম ব্যবসায়িক পার্টনার পুঁজিবাজারের আলোচিত বিনিয়োগকারী মো. আবুল খায়ের হিরুকে ২৫ লাখ টাকা, তাদের প্রতিষ্ঠান মোনার্ক মার্টকে ১ লাখ টাকা, হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতবরকে ১০ লাখ টাকা, হিরুর প্রতিষ্ঠান লাভা ইলেকট্রোডস ইন্ডাস্ট্রিজকে ১ লাখ টাকা, ইশাল কমিউনিকেশন লিমিটেডকে ৭৫ লাখ টাকা এবং মো. জাহিদ কামালকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দেওয়া অভিযোগে সাকিব আল হাসানকে শেয়ারবাজার কারসাজির নায়ক আবুল খায়ের হিরু গ্রুপের সদস্য উল্লেখ করা হয়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিএসইসির শুভেচ্ছা দূত থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় সাকিবকে। অভিযোগে বলা হয়, সাকিব বেট উইনার অনলাইন জুয়া প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ক্রিকেট খেলাসহ অন্যান্য গেম এবং ক্যাসিনো জুয়ার কারবার প্রচার করেছেন। সাকিবের আরেক ব্যবসায়িক পার্টনার রাশেক রহমানের সঙ্গে রিলায়েবল কমোডিটিস এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ও বুরাক কমোডিটিস এক্সচেঞ্জ কোম্পানির মাধ্যমে আইন ও বিধি না মেনে সোনার ব্যবসা শুরু করেন। সরকারের শুল্ক ও রাজস্ব এড়িয়ে অবৈধ স্বর্ণের ব্যবসা করে চোরাচালানের অপরাধ করেছেন। অনুমতি না নেওয়ায় রাশেক রহমানের কাছে ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছিল।
সাকিব ‘মোনার্ক হোল্ডিংস’-এর কাগজপত্রে নিজের বাবার নামের জায়গায় ভুয়া নাম ব্যবহার করেছেন। ২০১৬ সালে সাতক্ষীরার দাতিনাখালী এলাকায় সাকিব আল হাসান অ্যাগ্রো ফার্ম নামে একটি কাঁকড়ার খামার গড়ে সফট সেল কাকড়া সংগ্রহ করলেও ব্যবসায়ীদের প্রায় ১ কোটি টাকা পরিশোধ করেননি। ২০১৯ সালে ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়ে গোপন করায় আইসিসি থেকে দুই বছরের জন্য সাকিব আল হাসানকে নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া পাওয়ার প্ল্যান্টের লাইসেন্স, পিপলস ব্যাংকের মালিকানা, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল ব্যবসা, কক্সবাজারের হোটেল হোয়াইট স্যান্ডে ২০ হাজার বর্গফুট বাণিজ্যিক স্পেসের মালিকানা, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় যুক্ত রয়েছেন সাকিব আল হাসান।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত এশিয়া ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ারদর ৩০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে ৬৮ টাকা ৬০ পয়সা ছিল। সাকিব এই কোম্পানির ৮ লাখ ২০ হাজার শেয়ার কিনলেও বিক্রি করেছিলেন ২ লাখ শেয়ার। এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজি করায় আবুল খায়ের হিরুর দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ লিমিটেডকে ৭২ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল। ২০২১ সালের ৫ মে থেকে ২৪ মে পর্যন্ত সময়ে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১২ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বেড়ে ৩৩ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছিল। সাকিব আল হাসান ব্যাংকটির ২৭ লাখ শেয়ার কিনে বিক্রি করেছিলেন ১ লাখ শেয়ার। শেয়ার কারসাজির কারণে বিএসইসি আবুল খায়ের হিরুর বোন কনিকা আফরোজ ও তার সহযোগীদের ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করে। একই বছরের ২০ মে থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত যারা ফরচুন সুজ লিমিটেডের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার লেনদেন করে তাদের মধ্যে ছিল সাকিব আল হাসান। তিনি কোম্পানিটির ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৩টি শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেন ১ লাখ ৮৩ হাজার ২৪৩টি। বিপুল পরিমাণ শেয়ার লেনদেন নিয়ে তদন্ত করে ঢাকা স্টক একচেঞ্জ (ডিএসই)। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে হিরুর পিতা আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের দেড় কোটি টাকা জরিমানা করে। ১৫ দিনের ব্যবধানে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ২০ টাকা ১০ পয়সা ওঠে। সাকিব ব্যাংকটির ৭৫ লাখ ১ হাজার ৬৭৬টি শেয়ার কেনার বিপরীতে ১০ লাখ ২০ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছিলেন।
শেয়ার লেনদেন নিয়ে তদন্তে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লেনদেনকারীদের তালিকায় সাকিব আল হাসানের নাম আসে। ব্যাংকটির শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার কারণে বিএসইসি আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের ৩ কোটি টাকা জরিমানা করে। ২০২২ সালের ২৯ মার্চ আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের শেয়ারদর ছিল ৩৪ টাকা। প্রায় এক মাস পর ২৪ এপ্রিল দর বেড়ে ৫৪ টাকা ৭০ পয়সায় দাঁড়ায়। ওই সময় সাকিব আল হাসান আইপিডিসির ১১ লাখ শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেছিলেন ১০ লাখ ৬৯ হাজার ৪৩৩টি শেয়ার। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার লেনদেন নিয়ে ডিএসই তদন্তে শেয়ার কারসাজির জন্য বিএসইসি মো. আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীদের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে। ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার লেনদেন করেছেন সাকিব আল হাসান। সার্বিক বিষয়ে সাকিব আল হাসানের বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।