ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে একজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় চারজন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। ভাঙচুর করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কটি গাড়ি। আশুলিয়ার টঙ্গাবাড়ী এলাকার মণ্ডল নিটওয়্যার কারখানার সামনে গতকাল দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। হামলা-সংঘর্ষে জড়িত সন্দেহে তিন নারীসহ ৫১ জনকে আটক করা হয়েছে। নিহত শ্রমিকের নাম কাউসার আহাম্মেদ (২৬)। তিনি টঙ্গাবাড়ীর ম্যাঙ্গো টেক্স লিমিটেড কারখানায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, সোমবার সকাল থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তৈরি পোশাক শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছিলেন। দুপুরের দিকে মণ্ডল নিটওয়্যার কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ত্রিপক্ষীয় মিটিং চলছিল। সমঝোতা না হওয়ায় শ্রমিকরা কারখানার বাইরে অবস্থান নেন। অন্য কারখানার শ্রমিকরাও সেখানে জড়ো হতে থাকেন। একপর্যায়ে পার্শ্ববর্তী ম্যাঙ্গো টেক্স ও ন্যাচারাল ডেনিম কারখানার শ্রমিকরা আমাদের ওপর হামলা করেন। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জসহ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়।
আশুলিয়ায় বেতন ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধিসহ ১৮ দফা দাবি পূরণের যৌথ ঘোষণার পর শিল্পকারখানায় স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিলেন তৈরি পোশাক শ্রমিকরা। এর মধ্যে কয়েকটি কারখানায় মালিক পক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের বনিবনা না হওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে কারখানাগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। এসব কারখানার শ্রমিকরা একজোট হয়ে বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে আন্দোলন করে আসছেন। শ্রমিকরা দলবেঁধে চালু থাকা কারখানায় গিয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে হামলা ও ভাঙচুর চালালে কারখানা কর্তৃপক্ষ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
শ্রমিকরা জানান, সকালে মণ্ডল গ্রুপের শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিটিংয়ে সমঝোতা না হওয়ায় বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা সেখানে জড়ো হতে থাকেন। দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শ্রমিকরা র?্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। হামলায় শিল্প পুলিশের এসপি সারোয়ার আলম গুরুতর আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ শ্রমিকদের লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
বাড়তি নিরাপত্তা চান পোশাক মালিকরা : ঢাকার আশুলিয়া ও সাভারে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে পোশাক কারখানা চালু রাখতে নিরাপত্তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন মালিকরা। গতকাল রাজধানীর উত্তরায় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভবনে সংবাদ সম্মেলনে তারা এ আহ্বান জানান।
দুঃখ প্রকাশ : আশুলিয়ায় সংঘর্ষে শ্রমিক কাউসার হোসেন খান নিহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। একই সঙ্গে তাঁর পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। নিহত ওই শ্রমিক জিরাবো এলাকার ম্যাঙ্গো টেক্স লিমিটেড কারখানায় কাজ করতেন। গতকাল বিজিএমইএ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গতকাল টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের জিরাবো এলাকার মণ্ডল গ্রুপের কারখানায় মণ্ডল গ্রুপের শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে মালিক পক্ষের আলোচনা চলছিল। এ সময় কিছু বহিরাগত ব্যক্তি মণ্ডল গ্রুপের দুজন শ্রমিকের মৃত্যুর মিথ্যা গুজব তুলে কারখানার বাইরে অবস্থান নেন। পরে অন্যান্য কারখানার শ্রমিকরাও সেখানে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় দুজন বহিরাগত ব্যক্তি কারখানার বাইরে থেকে কারখানা লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে। এতে কারখানা ভবনের কাঁচ ভেঙে যায় এবং আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কারখানার নিচে নেমে আসেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও শ্রমিকরা মুখোমুখি অবস্থান নেন। বহিরাগত ও শ্রমিকরা মিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে শ্রমিকরা আরও উত্তেজিত হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য ও শ্রমিক গুরুতর আহত হলে আহত শ্রমিকদের স্থানীয় পিএমকে হাসপাতাল ও সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এনাম মেডিকেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শ্রমিক কাউসার হোসেন খানকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি আশুলিয়ার জিরাবো এলাকার ম্যাঙ্গো টেক্স লিমিটেড কারখানার শ্রমিক। বিজিএমইএ শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে। সংঘর্ষের ঘটনায় আহত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১১ জন সদস্য বর্তমানে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বিজিএমইএ পোশাক শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করেছে।
ইতোমধ্যে নিহত শ্রমিক, কাউসার হোসেন খানের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। শ্রম আইন অনুযায়ী তার সব পাওনা অতি দ্রুত পরিশোধ করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে কারখানা মালিকরা বলেন, শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি আদায়ের পরও পোশাক খাতে অসন্তোষ বিরাজ করছে। কারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগ নিয়ে কিছু মহল গুজব ছড়াচ্ছে। চলমান শ্রমিক অসন্তোষের কারণে আশুলিয়া, জিরানি ও জিরাবোর মতো শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলো প্রতিদিনই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
একাধিক কারখানা মালিক বলেন, যে কারখানাগুলো মাসের বেশির ভাগ দিন বন্ধ ছিল, সেখানে বেতন পরিশোধ করাও এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বাইরের সংকটের কারণে ভালো কারখানাগুলোও উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। এখনো ঠুনকো কারণে কারখানায় আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। গতকালও কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর এবং লিড সার্টিফাইড কারখানায় আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মালিকরা বলেন, শ্রমিকরা ভাঙচুর করবে, অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে, আবার তাদের বিচার করা যাবে না, এটা হতে পারে না। অনেক ক্রেতা ক্রয়াদেশ বাতিল করছেন। অনেক ক্রেতার কাছে সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে এয়ার কার্গোতে পাঠাতে হচ্ছে। এতে হাজার হাজার ডলার মাশুল গুনতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কারখানা চালু রাখতে বাড়তি নিরাপত্তা চান তৈরি পোশাক মালিকরা।
সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, আমরা নিরাপত্তার দাবি জানাচ্ছি, তা না হলে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে আমাদের কারখানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এখানে যথেষ্ট নজর দিতে হবে। মালিকরা যে নিরাপত্তা চাচ্ছেন, এটা তাদের অধিকার।