সংস্কারের পর নির্বাচন দেওয়া এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা জানান।
এ সময় সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত দিন হবে তা সরকারই জানাবে। যখন আমাদের মুখ থেকে শুনবেন, তখন সেটাই হবে তারিখ। মেয়াদ নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হলেও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলেও জানান তিনি।
গত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার পর নিউইয়র্কে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগকে এ সাক্ষাৎকার দেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া, সার্ক পুনরায় কার্যকরভাবে চালু করার ব্যাপারে পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে জাতিসংঘ অধিবেশনের ব্যস্ততার ফাঁকে আলোচনা করা, সংবিধান সংস্কারসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়ে তাঁর সরকারের উদ্যোগ ও অগ্রগতি, বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে বাঙালিদের সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ও সহিংসতা, রোহিঙ্গা সংকট ইত্যাদি বিষয়েও কথা বলেন। শিক্ষার্থীরাই কি দেশ চালাচ্ছে কি না জানতে চাইলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, চালানো উচিত বলছি। চালাচ্ছে বলছি না। চালানো উচিত। আমি বরাবরই বলে আসছি, এখানে এ দায়িত্ব পালন করার আগে থেকেই বলছি, তরুণদেরই দেশ চালানো উচিত। তারাই তাদের ভবিষ্যৎ রচনা করবে। সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ড. ইউনূস জানান, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশের ভূমিকা নেওয়ার কথা থাকলেও গণ অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের হত্যা করাসহ সামগ্রিক বিষয়ে পুলিশের ব্যাপারে নেতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয়েছে। মনোবল ভেঙে যাওয়ায় পুলিশকে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যাচ্ছিল না। এ কাজে আনসার নিয়োগ করেও ফল আসেনি। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনীকে দুই মাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, পুলিশের সবাই তো আর অন্যায় করেনি। যারা অন্যায় করেছে তাদের চিহ্নিত করব, তাদের শাস্তি হবে। বাকিরা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। সশস্ত্র বাহিনীকে যে সময়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যেই পুলিশ ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা প্রকাশ করেন ড. ইউনূস।
বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত, গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ প্রসঙ্গে ইউনূস জানান, এটি একটি আইনগত বিষয় এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের দুই দেশেরই স্বার্থ হলো অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা। মাঝে মাঝে কতগুলো প্রশ্ন এসে যায় যেখানে সম্পর্কে একটু চির ধরে। যেমন- সীমান্তে গুলি করল, বাচ্চা মেয়ে মারা গেল, বাচ্চা ছেলে মারা গেল, এগুলো মনে কষ্ট দেয়। তবে এ ধরনের ঘটনা ভারত সরকারের অনিচ্ছাকৃত মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটাতে আমরা মনে করি না যে ভারতের সরকার ইচ্ছা করে এসব করেছে।
একাত্তরে গণহত্যার বিষয়ে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা না চাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ড. ইউনূস বলেন, সেটা পৃথক বিষয়। এটা কীভাবে হবে সেটা পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা হবে। কিন্তু সার্ক একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমরা চাই এটা শক্তিশালী হোক এবং সেই চেষ্টা আমি করে যাব। সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, আগের সরকার সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। সেখান থেকে পুনর্জাগরণ করতে হবে। এর জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা কমিশন গঠন করছি। ছয়টি করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি সংবিধান নিয়ে। আরও কমিশন আসছে। তিনি আরও বলেন, সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে সারা দেশ একমত। কী বিষয়ে বা কীভাবে হবে, তা নিয়ে বিতর্ক হবে। কমিশন একটা রূপরেখা দেবে, সেটা নিয়ে সারা দেশে বিতর্ক করার সুযোগ তৈরি করা হবে, যেন রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করে এবং সবাই মিলে ঠিক করে যে, এই সংশোধন এখনই করবে নাকি পরবর্তীতে।
ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখব : ফিলিস্তিনিরা তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবেন- আশা প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে সমর্থন অব্যাহত রাখব। ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ রামাদান গতকাল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁর বাসভবন যমুনায় সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে এ কথা বলেন ড. ইউনূস। বৈঠকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি বৈশ্বিক সমর্থন, গাজায় গণহত্যা ও মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়।
সাক্ষাৎকালে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত ইউসুফ রামাদান জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রশংসা করে বলেন, এটি সময়োপযোগী এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলোকপাত করেছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে ফিলিস্তিন ইস্যুতে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও এর জনগণের প্রতি বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থনের কথা জানান।
ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত জানান, অন্তত ৬০ জন ফিলিস্তিনি বাংলাদেশের মেডিকেলে পড়াশোনা শেষ করে চিকিৎসক হিসেবে এখন গাজায় রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। এ ছাড়া আরও দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অপেক্ষায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।