স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেছেন, কোনো দুর্নীতি আমরা সহ্য করব না। দুর্নীতি যাতে কমিয়ে আনা যায় সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর পরও এমন কোনো তথ্য পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মঙ্গলবার রাতে সচিবালয়ে নিজ অফিসকক্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি না থাকায় কী অসুবিধা হচ্ছে কিংবা জনপ্রতিনিধি ছাড়া বড় শহরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হচ্ছে কি না-জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, স্থানীয় সরকারের পরিধি বা ব্যাপ্তি ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত। সিটি, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ। সে ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধির সংখ্যা কয়েক হাজার। তাদের অনুপস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই কাজে কিছুটা ব্যাঘাত হয়। কাউকে বাধা দেওয়া হয়নি কিন্তু কেউ উপস্থিত নেই। তিনি আরও বলেন, আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিভিন্ন এলাকায় যে কন্ট্রাক্টর ছিলেন উন্নয়ন কাজের জন্য, তারাও অনুপস্থিত। এতে একটা বিষয় বোঝা যায়, তারা সবাই বিগত দিনের অবিচার-অন্যায় স্বীকার করেছেন। তা না হলে তাদের তো পালিয়ে যাওয়ার কারণ ছিল না। উপদেষ্টা বলেন, আমরা তৃতীয় দিন থেকেই ব্যবস্থা নিয়েছি। জনপ্রতিনিধির কার্যালয়ে মানুষের সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন হয় জন্ম, মৃত্যু সনদ, চারিত্রিক সনদ, নাগরিক সনদ। সরকার শুরুতেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি ধাপেই সরকারি কর্মচারীদের মাধ্যমে এটা করা হয়েছে। কয়েকটি ওয়ার্ড মিলে একেকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথম দিকে জনগণ বুঝতে না পারায় অনেকেই কাউন্সিলর অফিসে যেত, পরে বোঝার পর নির্দিষ্ট অফিসে যাচ্ছে। কাউন্সিলর অফিসে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সরকারি কর্মচারী আছেন সহায়তা করার জন্য। ডেঙ্গু মোকাবিলা প্রসঙ্গে উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেন, এটা ডেঙ্গুর সিজন। জুন-জুলাই, ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলে গেছে গণ অভ্যুত্থানে। এরপর আমরা প্রথমেই এ-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির মিটিং করেছি। বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ফগিং এবং মশার ওষুধ দেওয়ার বিষয়ে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবেও বলা হয়েছে। যেখানে সেখানে পানি না জমানো, ফুলের টবের পানি পরিষ্কার রাখা এসব বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার করি। তিনটি মিটিং এরই মধ্যে করেছি। ইতোমধ্যে আমরা ডেঙ্গু মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি করেছি। বহু আগে থেকেই বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা উচিত ছিল। বিগত বছরগুলোয় সম্পৃক্ত করা দরকার ছিল। কারণ তাঁরা হচ্ছেন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। একটি মশার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদের নখদর্পণে। কীভাবে ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হয় এ জ্ঞান তাঁদের আছে। আমার জানামতে, বিশেষজ্ঞদের মিটিং এটাই প্রথম। আগে মতামত নেওয়া হতো তবে সরাসরি কমিটি কখনোই হয়নি। এতে আমাদের কাজে ভ্যালু অ্যাড হয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই জায়গাতেই রাখা হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি বা তাৎক্ষণিক পরামর্শ দেবেন তাঁরা। ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর বাইরের শহরেও ডেঙ্গুর হটস্পট চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সে ক্ষেত্রে কতটুকু পূরণ হচ্ছে-জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, এ সরকার কোনো রুটিন কেয়ারটেকার সরকার নয়। ১৩তম সংশোধন বাতিল করা হলো। যেটা অসাংবিধানিকভাবে করা হয়েছে, যার এখতিয়ার ছিল না। এবার গণ অভ্যুত্থানে যে সরকার এলো আমরা হলাম ট্রাস্টি। ছাত্র-জনতা-শ্রমিক তাদের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা পেল, দ্বিতীয় স্বাধীনতা তারা বলছে। ছাত্র-জনতা আমাদের একটি দায়িত্ব দিয়েছে সেটি পালন করতেই এসেছি। তাদের প্রত্যাশা হলো-১ নম্বর সংস্কার, ২ নম্বর সংস্কার এবং ৩ নম্বর সংস্কার। এ সংস্কারের জন্যই আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ। প্রতিটি মন্ত্রণালয় তার যতগুলো প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় আছে সেগুলো সংস্কারের জন্য কাজ করছি। ইতোমধ্যে ছয়টি কমিশন হয়েছে, এ কমিশনের রিপোর্ট পেলে আবার আলোচনা হবে। সংস্কারের একটা রূপ তখন সামনে আসবে। সংস্কারের মধ্যে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক আমার এখতিয়ারের মধ্যে যা আছে এর মধ্যে সিটি করপোরেশন থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের একটা ব্যাপার আছে। অলরেডি আমরা কাজ করছি। কোথায় ত্রুটি, এতগুলো প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও কেন কাজ এগোয় না তা দেখছি। এলজিইডি, পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্ট এগুলোয় অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা আছে যা পুঞ্জীভূত। ১৫-১৬ বছর ধরে তাদের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য চাকরিবিধি তৈরি করতে পারেনি। গ্রেডেশন লিস্ট নিয়ে মারামারি করে, আদালত পর্যন্ত দৌড়ায়। এটা সরকারেরই ব্যর্থতা যে সুনির্দিষ্ট চাকরি বিধিমালা, গ্রেডেশন লিস্ট এগুলো তৈরি করে যেতে পারেনি। এসব সুষ্ঠুভাবে সমাধান করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেন, পল্লী উন্নয়ন প্রতিটি গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে দুটি ভাগ। একটি হচ্ছে রাস্তাঘাট ইত্যাদি তৈরি করা, আরেকটি মানব উন্নয়ন। ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কী করবে এটি সচেতন করা, সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। যেটা গ্রামীণ ব্যাংক শুরু করেছে সেই ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে সহায়তা করা। এটারই মাধ্যমে একটা পর্যায়ে তাকে উদ্যোক্তা করা। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একজন মুরগি কিনল, কোথাও সেটা বিক্রি করল। এখন হয়তো ছোটখাটো পোলট্রি দিল। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যে সহায়ক ভূমিকা অর্থাৎ মানব উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া। তিনি বলেন, রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি হচ্ছে। কাবিখা, টাবিখার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ইউনিয়ন পরিষদের যে স্থানীয় সরকার তার সঙ্গে রুরাল ডেভেলপমেন্টের একটা সম্পর্ক হওয়া দরকার। আমরা মনে করি, এটা জরুরি। এভাবে আগে চিন্তা করা হয়নি। এলাকার ওয়ার্ড মেম্বার কিন্তু উন্নয়নের বিষয়ে সচেতন নন, সমবায় বিষয়ে সচেতন নন। সমবায় আরেকটি প্রতিষ্ঠান, এটি গ্রামীণ উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের সমবায়ের মানসিকতা আনতে হবে। স্থানীয় সরকারকে শুধু রাজনীতি নয়, স্থানীয় উন্নয়নে সম্পৃক্ত করতে হবে, মনমানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কো-অপারেটিভের জন্য কমিটি করেছি।
১৫-১৬ বছর ধরে এসব জঞ্জাল জমেছে আর আমাদের সময় গেছে ছয় সপ্তাহ। এ ছয় সপ্তাহে এতদিনের জঞ্জাল দূর হবে না। আমরা সেই মনমানসিকতা নিয়ে কাজে নেমেছি। প্রশ্ন উঠতে পারে দৃশ্যমান তো দেখছি না। আমাদের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে কাজ হচ্ছে। তবে সেটি আরও দৃশ্যমান করতে হবে বলে আমি মনে করি।
সারা দেশের মানুষের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, সজাগ এবং সতর্ক থাকা। এই যে গণ অভ্যুত্থান এবং সব ক্ষেত্রে সংস্কার। গণ অভ্যুত্থানে এবার লক্ষণীয় যে, অন্য সব সময়ই আন্দোলন হয়েছে ঢাকাকেন্দ্রিক। এবার ব্যতিক্রম বাংলাদেশের ৫০ বছরের যাত্রায় এ গণ অভ্যুত্থান ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল না। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ গণ আন্দোলনের জোয়ার পৌঁছে গেছে। সেটি বুঝলাম, ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক, অনেক মেম্বার পলাতক। কিসের জন্য এ জোয়ার সেই ইউনিয়ন পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই যে গণজাগরণ এটা বাংলাদেশের সর্বত্র হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে বোঝা যাচ্ছে, ইউনিয়ন পর্যন্ত সুবিধা আছে। পালিয়ে যাওয়া মানেই হচ্ছে অন্যায়ভাবে অর্জন করা জায়গায় ছিলাম, এজন্য পালিয়েছি। পালানোর মধ্যে অনেক কিছু প্রকাশ পাচ্ছে। তারা চাইবে যে কোনোভাবে হারানো অন্যায় সম্পদটা ফিরে পেতে। আমরা চারদিকে যে অস্বস্তিকর পরিবেশ দেখছি বিশেষ করে শিল্প এলাকায়। এখানে একটা অশান্ত পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে এবং হচ্ছে। দেনাপাওনার বিষয় থাকলে মালিক আর শ্রমিক বসেই তো সমাধান করতে পারে। অনেক স্থানে সমাধান হয়েছেও। সরকারের উদ্যোগে আলোচনা হয়েছে। এর পরও দেখা গেছে শ্রমিক আন্দোলন চলছে। এটা সত্যি যে, অনেকে জুলাই-আগস্টের বেতন পাননি। এটা ওই সময়ের অবস্থার কারণে হয়তো কিছু মালিক দিতে পারেননি। আবার কিছু মালিক আছেন যারা এ আন্দোলন/গণ অভ্যুত্থানকে পছন্দ করেননি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেতনটা দেননি। যাতে শ্রমিকদের মধ্যে একটা অসন্তোষ হয়, এ সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব জন্মায়। এ প্রচেষ্টা সর্বত্র চলছে। এজন্য জনগণের কাছে প্রত্যাশা সতর্ক এবং সজাগ থাকা। আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো দিনই কোনো সমস্যা হয়নি। এটা পোড়ানোর উদ্দেশ্য হলো, এটা রপ্তানি ইন্ডাস্ট্রি। আমাদের স্ট্যান্ডার্ড অনেক আন্তর্জাতিক মানের। ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি নষ্ট হলে আবার বিদেশিদের কাছে হাত পাতব একটা ট্যাবলেটের জন্য। এখানে বিভিন্ন ধরনের উসকানি আছে, স্বার্থ কাজ করছে। এ সরকারের আমলে অর্থনীতি পঙ্গু করার একটা ষড়যন্ত্র চলছে। জনগণ এগিয়ে আসছে, বাধাও দিচ্ছে। ভূমি অফিসের নানা দুর্নীতির খবর প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, ভূমি অফিসে মানুষের ভোগান্তি কমাতে ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি। ভূমির বিভিন্ন পার্টনারের সহায়তায় অটোমেশন কার্যক্রম চলছে। জমির ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার বা কেনা হলে মিউটেশন করাতে হয়। খতিয়ান, খাজনার রসিদ পেতে একটা হয়রানি হয়। গল্পেই আছে-৫ টাকার খাজনা দিতে গেলে ১০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এটা অটোমেশনের মাধ্যমে চিরতরে দূর করার শেষ প্রান্তে আছি। উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, বিভিন্ন মিটিংয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কোনো দুর্নীতি আমরা সহ্য করব না। প্রয়োজনে বদলি করা হবে। অনেকেই বলেন, বদলি করলে দুর্নীতিও বদলি হয়। তবে বদলি হলেও সে অফিসও বিচলিত হয়, একটা প্রভাব পড়ে। দুর্নীতি যাতে কমিয়ে নিয়ে আসা যায়, সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। মানুষের সঙ্গে লেনদেন হলে দুর্নীতি হতে পারে, এজন্য অটোমেশনে গুরুত্ব দিচ্ছি। জমি নিয়ে সামাজিক কত ধরনের সমস্যা হতো। এখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জমির জরিপ হচ্ছে। ভবিষ্যতে আর সমস্যা হবে না। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নির্ভুল জরিপ হবে, সেখানে সব তথ্য থাকবে। এতে অন্য কাজ করতেও কিন্তু সুবিধা হবে।