দুই মাসেও কাজে যোগ দেননি পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ১৮৭ জন সদস্য। তাদের অনেকেই এরই মধ্যে দেশ ছেড়েছেন। অনেকে দেশে থাকলেও গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে রয়েছেন। শিগগিরই তারা কাজে যোগ দিচ্ছেন না। সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, অনুপস্থিত থাকা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে যারা ফৌজদারি মামলার আসামি হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচারকাজ আইন অনুযায়ী চলবে। সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। হত্যাযজ্ঞে জড়িত থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ তৈরি হয় পুলিশের বিরুদ্ধে। গত ৫ আগস্টের পর নিরাপত্তার স্বার্থে সেনানিবাসে আশ্রয় নেন ৫১৫ জন পুলিশ সদস্য-কর্মকর্তা। এরপর এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি পুলিশে। মানবাধিকার কর্মী ও হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা নূর খান লিটন বলেন, পুলিশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। যাতে পুলিশ সদস্যরা কখনোই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়। তবে এটা সত্যি, পুলিশ ছাড়া আমাদের চলেও না। অতীতে বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের ব্যবস্থা থাকলে দেশের এমন পরিস্থিতি দেখতে হতো না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশের যেসব প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে এরই মধ্যে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে তাদের বেশির ভাগই পলাতক। এদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ (ডিবি হারুন)। তিনি এখনো চাকরিতে বহাল রয়েছেন। তবে ডিবির হারুন ছাড়াও অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই গ্রেপ্তার এড়াতে গোপনে দেশ ছেড়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। আবার কেউ শিক্ষা ছুটি, কেউ বা অসুস্থতার কথা বলে কিংবা লিয়েন (অনুমোদন নিয়ে অন্যত্র চাকরি) নিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।
ডিবির হারুন হত্যা মামলার আসামি। ১৩ বছর পর গত ১৯ আগস্ট জয়নুল আবদিন ফারুক নিজেই বাদী হয়ে ডিএমপির শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। পলাতক হিসেবে হারুনকে পুলিশ সদর দপ্তরের তালিকায় এক নম্বরে রাখা হয়েছে। সর্বশেষ এই কর্মকর্তা ডিএমপির ডিবিপ্রধান হিসেবে বেশি সমালোচিত হন। ৫ আগস্টের পর থেকে তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ১৮ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘যেসব পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি, লুকিয়ে আছেন, তাদের আর যোগ দিতে দেওয়া হবে না।’ পরবর্তীতে ১ অক্টোবর সচিবালয়ে মন্ত্রণালয় সভাকক্ষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর যেসব পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগদান করেননি তাদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে।
কতজন পুলিশ এখনো কাজে যোগ দেননি? এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ১৮৭ জনের মতো ছিল। এরপর মনে হয় আর কেউ যোগদান করেননি। যারা যোগ দেননি, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের আমরা পুলিশ বলব না, তারা অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, কর্মস্থলে অনুপস্থিত ১৮৭ জনের আর যোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। পুলিশের চাকরিবিধি অনুযায়ী যারা এখনো কাজে যোগদান করেননি তাদের ধাপ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
দেশ ছাড়েন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মীর রেজাউল : একটি সূত্র জানায়, বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মীর রেজাউল আলম গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এমএইচ১০৩ এর একটি ফ্লাইটযোগে সিডনির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার নামে একাধিক মামলা হয়েছে। দুদকে তার নামে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
দেড় লাখ টাকায় দেশ ছাড়ার গুঞ্জন বিপ্লব সরকারের : গত ১২ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম ইউনিয়ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে চলে গেছেন ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ১০ সেপ্টেম্বর রাতে কোনো একসময় তিনি ভারতে প্রবেশ করেন। পাচারকারীদের এ সংক্রান্ত কয়েকটি কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে জেলাজুড়ে তুমুল আলোচনা ও গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্ত পার করার সময় বিপ্লব কুমারের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেওয়া হয় বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয় সাবেক ডিএমপি কমিশনার ফারুককে : গত ২০ আগস্ট ব্যাংককের উদ্দেশে দেশত্যাগের জন্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান। কিন্তু ডিবিকে তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি জানানো হলে খন্দকার গোলাম ফারুকের দেশত্যাগের বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়। পরে অবশ্য তিনি বিমানবন্দর থেকে বাসায় ফিরে যান। খন্দকার গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে ডিএমপির কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমার চোখের সমস্যা। এর আগে আমি ব্যাংককে গিয়ে অপারেশন করিয়েছি। সেটার ফলোআপ করতেই মূলত ব্যাংকক যেতে চেয়েছিলাম। আমি জানি যে আমার নামে সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মামলা হয়েছে। আমি তো পালাচ্ছিলাম না। চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলাম।’
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যেসব পুলিশ কর্মকর্তা আত্মগোপনে : ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামানসহ শীর্ষ পর্যায়ের অন্তত ২৩ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। অবসরে যাওয়ার আগে তাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে ছিলেন।
যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন : গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলির ঘটনায় পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এসব মামলায় পুলিশের সাবেক দুই আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হক, ডিবির ডিসি মশিউর রহমান, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবদুল্লাহিল কাফী ও যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচিত অন্তত সাত সদস্য এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
খোঁজা হচ্ছে যেসব কর্মকর্তাকে : শুধু ঢাকায় পুলিশের কমপক্ষে ৯৯ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা হয়েছে। তবে এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান ও ঢাকার সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাহিদুর রহমানসহ অন্তত ১০ কর্মকর্তার বিষয়ে অনুমতি নেওয়া হয়েছে। অনুমতি নেওয়া পুলিশ সদস্যের তালিকায় আরও রয়েছেন- ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সাবেক উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, ওয়ারী জোনের সাবেক অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) এস এম শামীম, ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগের সাবেক সহকারী কমিশনার তানজিল আহমেদ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) উত্তরার সহকারী পুলিশ সুপার (চট্টগ্রামের হাটহাজারী মডেল থানার সাবেক ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম। রফিকুলকে ২২ সেপ্টেম্বর চাকরি থেকে অবসরে পাঠানো হয়।
আত্মগোপনে যারা : কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া ১৮৭ সদস্যের যে তালিকা পুলিশ সদর দপ্তর দিয়েছে, এর মধ্যে ডিআইজি থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৬ জন। পুলিশ পরিদর্শক আছেন পাঁচজন, উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৪ জন। অন্যদের মধ্যে এএসআই ৯ জন, নায়েক সাতজন ও কনস্টেবল ১৩৬ জন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, কাজে যোগ না দেওয়া শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান (স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসরের আবেদন করেছেন), ডিএমপির সাবেক যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিবির সাবেক যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার উত্তম কুমার পাল এবং পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার।
পুলিশ সুপার থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার আত্মগোপনে থাকা অন্য আট কর্মকর্তা হলেন- আরপিএমপির উপপুলিশ কমিশনার মো. আবু মারুফ হোসেন, আরপিএমপি ডিবির উপপুলিশ কমিশনার মো. শাহ নূর আলম, ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মফিজুর রহমান ও মো. ইফতেখার মাহমুদ, আরপিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান ও মো. আল ইমরান হোসেন এবং সিরাজগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার রানা।
পরিদর্শক পদে কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া কর্মকর্তারা হলেন- লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার সাবেক ওসি মো. মাহফুজার রহমান, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ মডেল থানার পরিদর্শক খাদেমুল বাহার বিন আবেদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর সার্কেলের পরিদর্শক মো. ইউসুফ হাসান, ডিএমপির সাবেক পরিদর্শক জাকির হোসাইন ও ঢাকা জেলা পুলিশের পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন।