ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্য সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। যে কোনো সময় বেঁধে যেতে পারে এ যুদ্ধ। এদিকে মিত্র ইসরায়েলকে রক্ষায় ভূমধ্যসাগরে ন্যাটো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুসংখ্যক যুদ্ধজাহাজ, বিমান মোতায়েন করেছে। পাল্টা প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে ইরানের মিত্র রাশিয়া-চীনসহ কয়েকটি পক্ষকে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ইরান রবিবার থেকে আকাশপথ বন্ধ করে দিয়ে বিমান চলাচল সীমিত করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ দূতাবাস বৈরুত থেকে সব বাংলাদেশিকে সরে যেতে বলেছে। সূত্র : আলজাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি।
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ক্রমেই বাড়ছে যুদ্ধের উত্তেজনা। সাম্প্রতিক হামলা-পাল্টা হামলার হুঁশিয়ারিতে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বের নজর এখন ইরান-ইসরায়েল পরিস্থিতির দিকে। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘাত ঘিরে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করছেন অনেকে। আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা ইস্যুতে কার শক্তি কত বেশি তা নিয়েও চলছে আলোচনা। সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষে থাকা দেশগুলোর মধ্যে র্যাঙ্কিংয়ে ইরান ১৪তম আর ১৭তম অবস্থানে রয়েছে ইসরায়েল। এরই মধ্যে তেহরানকে সমুচিত জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইরানও পাল্টা জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। পাল্টাপাল্টি হুমকিতে দুই দেশের মধ্যে যে কোনো সময় পুরোদমে যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব ও সিআইএ প্রধান লিওন প্যানেটা সতর্ক করে বলেছেন, ইসরায়েল যদি ইরানে পাল্টা হামলা চালায় সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নতুন মোড় নিতে পারে। প্যানেটার ভাষ্য, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপগুলোই নির্ধারণ করবে এ সংঘাত একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নেবে কি না। গত শুক্রবার এমএসএনবিসি রিপোর্টস-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। প্যানেটা বলেন, ‘বর্তমানে সব পক্ষ থেকেই কঠোর কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু আসল বিষয়টি হচ্ছে সামরিক পদক্ষেপ কীভাবে পরিচালিত হবে। ইসরায়েল তাদের প্রতিক্রিয়া সীমিত করতে পারবে কি না, নাকি তারা সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে আঘাত হানবে- সেটি মূল প্রশ্ন। যদি তারা সর্বাত্মক আক্রমণে যায়, তবে ইরানও পাল্টা জবাব দেবে’। প্যানেটার দাবি, অতীতে সামরিকভাবে সফল হতে পারেনি ইসরায়েল। আর এখন সামরিকভাবে জয়ী হতে চাচ্ছেন নেতানিয়াহু। এ ধরনের পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে আশঙ্কা তার।
আরেক খবরে বলা হয়েছে, ভূমধ্যসাগরে বিপুল সামরিক শক্তি মোতায়েন করলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো গোষ্ঠী সব পক্ষকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নেতানিয়াহুর ইসরায়েল যে কোনো সময় ইরানে হামলা করবেই। তবে এ হামলা কোথায় করা হবে- তা নিয়ে নানা তথ্য রয়েছে। তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য তিনটি। যেমন ইরানের পরমাণু অস্ত্রভান্ডার, ড্রোন ও মিসা?ইল-ভান্ডার ও তেল ভান্ডার। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এখনো পর্যন্ত ইসরায়েল ইরানের পরমাণু অস্ত্রভান্ডারের প্রকৃত লোকেশন জানতে পারেনি। তারা শুধু জেনেছে, ইরানের ৬০ শতাংশ পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে নান্তাজ এবং ফোরডো নামক দুটি এলাকায়। সেটাও আন্ডারগ্রাউন্ডে। ফলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে কিছুই করা যাবে না। খবরে বলা হয়, এমন অবস্থায় ইসরায়েলি স্পাই এজেন্সি শিন বেট এবং মোসাদ হন্যে হয়ে খুঁজছে ইরানি পরমাণু অস্ত্রভান্ডারের লোকেশন। যদিও তাদের কাছে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ আভাস দিয়েছে, পাহাড়ের অভ্যন্তরে অনেক গভীরে রাখা আছে ইরানের তিনটি অস্ত্রভান্ডার। কিন্তু কোন পাহাড়- তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যাচ্ছে না। আমেরিকার সিআইএ, ইসরায়েলের মোসাদ এবং ব্রিটেনের এমআইসিক্স শুধু জেনেছে, অন্তত সাড়ে তিন মাইল এলাকাজুড়ে রয়েছে এ অস্ত্রভান্ডার। জি-সেভেনের বৈঠকের পর আপাতত সাতটি দেশের স্পাই এজেন্সি মোসাদ, সিআইএ, এমআইসিক্সের পাশাপাশি ইতালির এআ?ইএসই, জার্মানির বিএনডি, ফ্রান্সের ডিজিএসই মরিয়া হয়ে সন্ধান চালাচ্ছে সেগুলোর।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য রয়েছে, ইরানের তিনটি ভান্ডারের একটিতেও ইসরায়েল মিসা?ইল হামলা করলে তৎক্ষণাৎ প্রত্যাঘাত আসবে। আর সেটা হতে পারে ভয়াবহ। ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে ইরান মোটেও পিছপা হবে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ কারণেই বাইডেন প্রশাসন চাইছে- ইসরায়েল এমন কিছু না করুক যাতে বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যায়। কারণ সেক্ষেত্রে রাশিয়া এবং চীন ইরানের পাশে দাঁড়াবে। এমন হলে প্রবল আর্থিক মন্দার মধ্যে আবার একটি যুদ্ধ আমেরিকার মাথায় চেপে বসবে এবং এর জন্য সব দায়দায়িত্ব আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়া ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে চেপে বসবে। ফলে বাইডেন প্রশাসন রয়েছে উভয় সংকটে।
বাংলাদেশিদের সরে যাওয়ার আহ্বান : লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দাহিয়ে এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভয়াবহ বিমান হামলার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে এসব এলাকায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে অনুরোধ করেছে দূতাবাস। রবিবার দিবাগত রাতে এক জরুরি বার্তায় এ পরামর্শ দিয়েছে বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস। বার্তায় বলা হয়, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আপনাদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, রাতে বৈরুতের দাহিয়ে এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভয়াবহ বিমান হামলার ঝুঁকি রয়েছে। এ অবস্থায় সবাইকে অতিসত্বর দাহিয়ে এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ছেড়ে অন্যত্র তুলনামূলক নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।
গাজা ও বৈরুতে হামলা অব্যাহত : রবিবার রাতেও গাজা ও বৈরুতজুড়ে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। মধ্য গাজার দেইর আল-বালার একটি মসজিদ ও স্কুলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ৯৩। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যকর্মীদের দাবি, শনিবার রাত থেকে উত্তর গাজায় কমপক্ষে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। দক্ষিণ বৈরুতের শহরতলিতে বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১২ জন।
হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ : ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সামরিক শাখা গতকাল জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলের বাণিজ্যিক কেন্দ্র তেলআবিবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। চলমান যুদ্ধের অংশ হিসেবে তেলআবিবে এম-৯০ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে এজেদ্দিন আল-কাসাম ব্রিগেড। গতকাল দেশটিতে গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন হামলার এক বছরপূর্তি পালনের সময় এ আক্রমণ চালানো হয়।