হাসিনা বানু। তিন ছেলে ঢাকায় ঠিকা কাজ করে। তারা ঢাকাতেই থাকে। বৃদ্ধা হাসিনা নিজের ভিটে-বাড়ি আঁকড়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে ছিল এক ছেলে বউ। গত শুক্রবার নালিতাবাড়ীতে যে ভয়াবহ পাহাড়ি ঢল তান্ডব চালিয়ে গেছে- তাতে অন্য অনেকের মতো কপাল পুড়েছে এই বৃদ্ধারও। বসবাসের চৌচালা ঘর ভেসে গেছে পানির তোড়ে। দেয়ালের মাটি বানের পানিতে সরে যাওয়ার পর এখন শুধু টিনের চালাটা পড়ে আছে। সেই চালার সামনে বসে কথা হয় হাসিনা বানুর সঙ্গে। আটভাইপাড়া। নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বাতকুঁচি গ্রামের একটি ছোট্ট পাড়া। উত্তরে মেঘালয় পাহাড় থেকে ‘চেল্লাখালী’ নদী সাপের মতো এঁকেবেঁকে এসে সমতলে বয়ে গেছে। পাহাড় থেকে এই সমতলে নেমে আসার পথেই বাতকুঁচি গ্রামের আটভাইপাড়া। গত শুক্রবারের চেল্লাখালী নদীর ঢল এই পাড়ার বেশির ভাগ বাড়িঘর মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে গেছে। বারোমারি মিশনের পাকা রাস্তা থেকে পলাশীকুড়া উচ্চবিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে কিছুটা এগোতেই চোখে পড়ল ধ্বংসযজ্ঞ। হাতের ডান পাশে বয়ে যাওয়া ‘চেল্লাখালী’ নদী এখন অনেক শান্ত। এক সপ্তাহ আগে সে-ই পাহাড় থেকে ধেয়ে আসা বানের পানিতে এক শক্তিশালী দানব হয়ে উঠেছিল। ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল দুই পাশের গ্রাম- তা এখন আর বোঝার জো নেই। বোঝা যায় কিছুটা এগিয়ে মাটির রাস্তা ও তার পাশের ঘরবাড়ি দেখে। পানির স্রোত এত তীব্র ছিল যে, কাঁচা রাস্তার কোথাও কোথাও পনেরো থেকে বিশ হাত অবধি গর্ত হয়ে গেছে। ভয়াল স্রোতের সামনে যে বাড়িঘর ছিল- তার সবকিছু ভেঙেচুড়ে তছনছ করে দিয়ে গেছে।
বানের পানি নেমে গেছে। অনেক জায়গায় জেগে উঠেছে ধানখেত। নতুন করে শুরু হয়েছে গ্রামীণ মানুষের কর্মযজ্ঞ। কিন্তু এই আটভাইপাড়ার সবকিছু এখনো থেমে আছে। প্রায় এক সপ্তাহ পেরোলেও নালিতাবাড়ীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এই এলাকায়- না এখনো সরকারের কোনো সহায়তা পৌঁছেছে, না কোনো সরকারি প্রতিনিধি ওই এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। এ বিষয়ে শেরপুর জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সব জায়গায় সহায়তা পৌঁছানোর জন্য। আমাদের সক্ষমতা যতটা আছে, সব জায়গায় চেষ্টা করেছি। যেখানে সম্ভব হয়নি, কিংবা যেখানে আমরা নিজেরা যেতে পারিনি, সেখানে আমাদের সেনাবাহিনী সহায়তা দিয়েছে। কোথাও যখন আমরা অভিযোগ পেয়েছি- কেউ খাবার পায়নি বা উদ্ধার করা দরকার, সেখানে ছুটে গিয়েছি। আটপাড়ার দুর্গতদের সহায়তা প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক জানান, আমি আপনার কাছ থেকে জানলাম। ইউএনও সাহেবকে বলছি, এক্ষুনি খবর নেওয়ার জন্য। গ্রামের প্রথম যে ভাঙা বাড়িটি চোখে পড়ল সেটি সাজেদুলের বাড়ি। পেশায় দিনমজুর। ক্লাস এইটে পড়া এক মেয়ে নিয়ে তিন সদস্যের সংসার। খেয়েপরে মোটামুটি চলছিল তাদের। ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে এক সপ্তাহ আগের পাহাড়ি ঢলের কথা স্মরণ করে জানান, ‘আঙ্গর উপরে কিয়ামত নামছিল। বিষ্যুদবার থাইক্যাই হারারাইত বিষ্টি অইছে। পরদিন শুক্কুরবার সহালেও বিরাট বিষ্টি। পাহাইড়া পানিতে ‘চেল্লাখালী গাঙ’ উপচাইয়া পড়তাছে। আমরা বালুর বস্তা দিয়া পানি আটাকাইতে চাইতাছিলাম। এইসমু (এ সময়) সহাল ৮টার দিহে (দিকে) দেহি বিরাট এক পানির ঢেউ। সুনামীর লাহান আৎকা ঘরবাড়ি ভাসাইয়া লইয়া গেল গা। টেহাপইসা, ধানচাইল, বইটই কিছুই রাখবার পাই নাই’। ৪০ বছরের সাজেদুল জানান, তার জীবনেও এই এলাকায় এরকম বন্যা দেখেননি। সাজেদুলের পরের বাড়িটি মান্নানের, তারপর বাসেত, তারপর হাফিজুর, নুরুন্নাহার, আবদুর রহমান, রাজ্জাক, সাফিজুর- এভাবে একের পর এক পরিবার, যাদের বাড়ির বেশির ভাগ ঘর পাহাড়ি ঢলে ভেঙে গেছে। এলাকাবাসী জানান, পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে তারা ঘরের জিনিসপত্র সরিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগই পাননি। আচমকা বানের পানি ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ায় তারা আগে জীবন বাঁচানোর দিকে জোর দিয়েছেন। ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মান্নান জানান, বন্যার সময় এক-দুই দিন স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন এলাকার স্বেচ্ছাসেবী কিছু সংগঠন শুকনো খাবার দিয়ে গেছে। পানি নেমে যাওয়ার পর আর কেউ খবর রাখেনি। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তারা শুকনো খাবার খেয়েই বেঁচে আছেন। ঘর নাই, চাল নাই, চুলা নাই, হাড়িতেও জ¦লে না আগুন...। আটভাইপাড়ার শেষ যে ভাঙা বাড়িটা তার সামনে মলিন মুখে বসে ছিলেন এক বৃদ্ধা। তিনিই হাসিনা বানু। বয়স জানতে চাইল আঙুলের কড়া গুনে বললেন, চারকুড়ি পাঁচ- মানে পঁচাশি বছর। নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরে জানান, স্বামী হারানোর পর এক ছেলে বউকে নিয়ে কোনো মতে স্বামীর ভিটেবাড়ি আগলে ধরে জীবন পার করছিলেন। গত শুক্রবার পাহাড়ি ঢল সেই জীবন তছনছ করে দিয়ে গেছে। হাসিনা বানুর ভাষায়, ‘এই বাড়ি ওই বাড়ি কোনোরহম রাইতটা কাডাই। বেইন্নাবালাত্তে হাইঞ্জা পন্ত (সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত) ভাঙা ঘরের সামনেই বইয়া থাহি। কেউ আঙ্গর খোঁজ নেয় না। ঘরডা ভাইঙ্গা অহন আরও মইরা গেছি...।’