বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও অখন্ড ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যে প্রক্রিয়ায় ও যে গতিতে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা রাজনৈতিক মামলাগুলো প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে- তা সারা জীবনেও শেষ হবে না। তিনি বলেন, ২০০৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে দায়ের করা (প্রায়) ৪ লাখ মিথ্যা ও গায়েবি মামলা একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমেই প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার কোনো সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে যেভাবে তাদের সব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই এটা করতে হবে। অন্যথায় এ মামলা কখনোই শেষ হবে না।
গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সাবেক গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রী মির্জা আব্বাস এসব কথা বলেন। এ সময় দেশের সার্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থা, সরকারের উপদেষ্টাদের কার্যক্রম, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তাঁর নিজের দল বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা, দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৭ বছরে দায়ের করা (প্রায়) চার লাখ মিথ্যা ও গায়েবি মামলার সর্বশেষ অবস্থা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পতিত স্বৈরাচার সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও দোসরদের বিচারের আওতায় আনা, কোন ধরনের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা উচিত এবং আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা উচিত কিনা- এসব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।
বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে ঢাকা সিটির সাবেক এই মেয়র বলেন, সারা দেশে দল ও অঙ্গ সংগঠনের ৬০ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় ৪ লাখ মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত সাড়ে ১৭ বছরে দায়ের করা এসব মামলায় লাখ লাখ নেতা-কর্মী জেল খেটেছেন। জুলুম-নির্যাতন ও গুমের শিকার হয়েছেন। এমনকি মৃত্যুবরণও করেছেন অনেকে। কিন্তু মামলা এখনো শেষ হয়নি। এসব রাজনৈতিক মামলা শেষ করার একটা শ্লথ (গতি) প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ প্রক্রিয়ায় সারা জীবনেও এসব মামলা শেষ হবে না। মির্জা আব্বাস বলেন, দেশের একটি বৃহৎ ষড়যন্ত্রকারী চক্র পতিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। এর সঙ্গে রয়েছে দেশি-বিদেশি গভীর চক্রান্ত। বিএনপিকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে তারা বহুমুখী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু বিএনপি এমন একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল যা- সত্যিকার অর্থেই এদেশের সাধারণ জনগণের ওপর নির্ভরশীল। এ দলের বিরুদ্ধে অতীতে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে মিথ্যা মামলায় সাজানো রায় দিয়ে জেল খাটানো হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও প্রতিহিংসামূলক মামলা দিয়ে তাঁকেও ষড়যন্ত্র করে দেশের বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু এদের কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। কারণ বিএনপির সঙ্গে দেশের আপামর জনসাধারণ আছে। তবে এসব চক্রান্ত সম্পর্কে আমাদের সবাইকে সব সময় সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
বর্ষীয়ান এ রাজনীতিক বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন ঘোলাটে। অর্থনীতি পঙ্গু। রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অর্গানকে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে করে গেছেন। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাকে তিনি এমনভাবে বিনষ্ট করেছেন যে, রাজনীতির চরিত্রের ওপর এখন একটা মারাত্মক নেতিবাচক ও স্বৈরাচারী প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে দেশের রাজনীতিবিদদের বেশির ভাগই এখন একেকজন একেকটা ডিক্টেটর হয়ে বসে আছেন। দেশ থেকে রাজনৈতিক এই কুসংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা আব্বাস বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রচলিত ধারা অনুযায়ী অতীতে যা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকার যা-ই বলি না কেন, তারা তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করেছে। এভাবে অন্তত তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেগুলো ছিল স্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু এই অন্তর্বর্তী সরকারের আগমন ঘটেছে- পতিত সরকারের কৃত একটা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যদিয়ে। এই ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশের চালিকা শক্তিগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পরই তাদের নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। কারণ স্বৈরাচার শেখ হাসিনা এদেশ থেকে পালিয়ে অন্যত্র চলে গেলেও তার প্রেতাত্মা এবং মেশিনারিজগুলো এখনো বহাল তবিয়তে তাদের স্ব স্ব জায়গায় রয়ে গেছে। এই অবস্থায় কখনোই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, আগে বিগত ১৬ বছরের রেখে যাওয়া জগদ্দল পাথরের ভার সরিয়ে রাষ্ট্রের চালিকা শক্তিসমূহকে সুন্দর একটা অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসমূহ, নির্বাচন কমিশন, সর্বস্তরের মিডিয়া- এসব প্রতিষ্ঠানকে ন্যায়-নীতির আওতায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এগুলো হলো- বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অতিরিক্ত দায়িত্ব। এই কাজগুলো সম্পন্ন করে অন্তর্বর্তী সরকারকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যৌক্তিক একটা সময় নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। যা কোনোক্রমেই অতি বিলম্ব হওয়া যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, অনেক উপদেষ্টার বেশ কিছু কর্মকান্ড (বক্তব্য) জনমনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আসলে তারা কী চান? সরকার গঠনের আগে এক ধরনের কথা বলেছেন, এখন আবার অন্য ধরনের কথা বলছেন। তারা যেভাবে সংস্কার করার কথা বলছেন- তাতে এই জনমে সংস্কারের কাজ কখনোই শেষ হবে না। সুতরাং যেগুলো নেহায়েতই প্রয়োজন, শুধু সেসব বিষয়েই এই অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার সাধন করতে হবে। আসলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরই রাষ্ট্র সংস্কার করা উচিত। সম্প্রতি বিএনপি থেকে গণহারে দলীয় নেতা-কর্মীদের বহিষ্কার করা হচ্ছে- এতে দলে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে? এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, এতে অন্যরা সাবধান হবে। দীর্ঘদিনের একজন কর্মীকে তো সহজেই কেউ দল থেকে বহিষ্কার বা তার সদস্য পদ স্থগিত করতে চায় না। যখন একজন নেতা বা কর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কারাদেশ প্রদান করা হয়- তখন সবকিছু দেখেশুনে এবং জেনেবুঝে যৌক্তিকভাবেই সেটা করা হয়। যা অন্যদের জন্য একটা সতর্ক সংকেত। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে নাগাদ দেশে ফিরবেন- এ সম্পর্কে মির্জা আব্বাস বলেন, সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ করেই তিনি দেশে ফিরবেন। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে। তবে মামলা প্রত্যাহারের এই প্রক্রিয়াটা আরও তাড়াতাড়ি হওয়া উচিত। অন্যথায় জননেতা তারেক রহমানের দেশে ফেরানোর বিষয়ে বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকারের মনোভাব নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দেবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন প্রসঙ্গে দলের এই নীতিনির্ধারক বলেন, আন্দোলনে আহতদের সম্পূর্ণভাবে সুস্থ করে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করা উচিত। সেটা দেশে বা বিদেশে যেখানেই হোক না কেন? আর হতাহতদের পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব পরিবার নিহত ব্যক্তিদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল- তাদের বিশেষভাবে দেখভালের দায়িত্ব সরকারের নেওয়া উচিত। মির্জা আব্বাস বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদেরসহ সব অপরাধীকেই দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারের আওতায় আনতে হবে। যারা অপরাধ করেছে, দেশের অর্থ-সম্পদ লুটপাট করেছে, বিদেশে পাচার করেছে, মানুষ হত্যা ও জবরদখল করেছে- এদের সবাইকেই বিচার ও আইনের আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে স্বৈরাচার ও খুনি শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে এই সরকারকে। দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ গণমাধ্যম সম্পর্কে সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে সিংহভাগ মিডিয়ার মালিক হয়েছেন আওয়ামী লীগের লোকেরা। দেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকেরা কেউই স্বাধীন নন। তাছাড়া পতিত সরকারের আমলে প্রণীত নানা রকমের কালো আইন, হয়রানিমূলক মামলা এবং তাদের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে কোনো মিডিয়ার পক্ষেই স্বাধীন থাকা সম্ভব হয়নি। বরং সাগর-রুনিসহ অনেক সাংবাদিককে প্রাণ দিতে হয়েছে পতিত সরকার ও সরকারের লোকদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে- নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, সর্বজন গ্রহণযোগ্য ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দিতে হবে। যিনি দলমত নির্বিশেষে সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে জাতিকে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হবেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মনে করেন কি না?- এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা আব্বাস বলেন, যে কোনো ফ্যাসিস্ট দলকেই নিষিদ্ধ করা উচিত।