অর্থনৈতিক, আর্থসামাজিক সূচক এবং কৃষি ও শিল্প-সংক্রান্ত পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিসংখ্যান ব্যবস্থার সব তথ্যেই গোলমাল। খোদ পরিসংখ্যান বিভাগের জরিপ করা তথ্যের ওপরই মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। গোলমেলে তথ্যের হিসাব নিয়েই সরকারের মধ্যেও ছিল নানা রকমের অসন্তোষ। ফলে বিভিন্ন বিষয়ে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতেও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে সাবেক স্বৈরসরকারকে। পরিসংখ্যানের গোঁজামিল তথ্যের চূড়ান্ত ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষের ওপর নেমে এসেছে নানা রকমের ভোগান্তি, যা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সৃষ্টি করেছে অস্থিরতা ও আস্থাহীনতা। শত কৌশলেও ঠেকানো যায়নি দ্রব্যমূল্যের ঊর্র্ধ্বগতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলের ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি সাধারণ মানুষকে। এ অবস্থায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকের প্রকৃত তথ্য প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে।
সূত্র জানায়, স্বৈরশাসকের তকমা নিয়ে বিদায় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকার ফাঁপা উন্নয়ন দেখাতে দেশের উৎপাদন, উন্নয়নের পরিসংখ্যানে গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়েছে ভয়াবহভাবে। খাদ্য উৎপাদন, মাছ, মাংস, দুুধ, ডিম, জনসংখ্যা, মাথাপিছু আয়, গড় বয়স, খেলাপি ঋণ, বেকারত্ব, দারিদ্র্য বিমোচন, জিডিপি, মূল্যস্ফীতিসহ সব খাতের পরিসংখ্যানেই ছিল ব্যাপক গরমিল। উৎপাদন ও উন্নয়নের সঠিক হিসাব পেতে উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য ‘মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি’র প্রকৃত হার নিরূপণ, ‘রাজস্ব’ এবং ‘রপ্তানি’ আয়ের সঠিক হিসাব বের করার নির্দেশনা দিয়েছে অর্থবিভাগ। সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সংস্কারের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে অর্থনীতির এই চারটি খাতে সংস্কারের কাজ শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। পর্যায়ক্রমে উৎপাদন, আমদানি, প্রকৃত চাহিদা, জনসংখ্যা, মাথাপিছু আয়সহ অন্য বিষয়গুলোর প্রকৃত পরিসংখ্যান বের করার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি সূত্র জানায়, উন্নয়নের ধাঁধা তৈরি করতে এবং মানুষকে প্রভাবিত করতে মূল্যস্ফীতির ডাটা কমিয়ে দেখানো হতো। একই সঙ্গে মাথাপিছু আয়, পণ্য উৎপাদন ও জিডিপির ডাটা বাড়িয়ে দেখানো হতো।
সূত্র জানায়, মার্কিন কৃষি বিভাগ ও বাংলাদেশ কৃষি বিভাগের তথ্যের তুলনা করে দেখা গেছে, প্রতি বছর ধান-চালের উৎপাদন প্রায় ৩০ লাখ টন বেশি দেখানো হয়েছে গত এক দশকে। একই সঙ্গে দুধের উৎপাদন ৫০ লাখ টন বেশি দেখানো হয়েছে বলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বিবিএসের সঙ্গে ডিএলএসের তথ্যের হিসাবে দেখা গেছে, ডিমের উৎপাদনেও ৩০ শতাংশ বেশি দেখানো হয়েছে। একই রকম তথ্যে গরমিল রয়েছে অন্যান্য কৃষি পণ্যের বেলায়ও। অন্যদিকে সর্বশেষ জনশুমারিতে প্রকৃত জনসংখ্যার তথ্য নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য কখনই উঠে আসেনি।
এদিকে জিডিপির তথ্য বাড়িয়ে দেখানো হলেও মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য কখনই প্রকাশ করা হয়নি। যার ফলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কৌশলও কাজে আসেনি গত দেড় দশকে। এদিকে স্বল্প উন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যেতে তাড়াহুড়ো করেছে সরকার। যার জন্য সামাজিক সূচক ও অর্থনৈতিক সূচকগুলোকে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে বারবার। সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যানে মাথাপিছু আয় দেখানো হয়েছে ২৭৮৪ ডলার। যা নিয়ে জনমনে রয়েছে অবিশ্বাস। বিশ্লেষকরাও বলছেন, এটা প্রকৃত তথ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হবে আরও কম। অন্যদিকে বেকারের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে। দেশে গত দেড় দশকে তেমন কোনো কর্মসংস্থান হয়নি। এর পর বেকারের সংখ্যা দেখানো হয়েছে মাত্র ২৭ লাখ, যা অবিশ্বাস্য বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সর্বশেষ প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। অথচ প্রকৃতপক্ষে এর পরিমাণ হবে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। এজন্য ব্যাংক খাতের চলমান নগদ টাকার সংকট সমাধান করা সম্ভব হয়নি দেড় দশকেও।
গোঁজামিলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও গড় আয়ুর ক্ষেত্রেও। মানুষের গড় আয়ু এক সময় দেখানো হয়েছিল ৭২ বছরের বেশি। এসব তথ্য নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি এবং অবিশ্বাস।
অর্থ বিভাগ মনে করে, প্রকৃত তথ্যে বড় গরমিল থাকায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভুল হিসাব তৈরি হচ্ছে। জিডিপির হার বাড়িয়ে দেখাতে গিয়ে খাদ্যের প্রকৃত উৎপাদন কম হলেও দেখানো হচ্ছে বেশি। এতে ঘাটতি মেটাতে খাদ্য আমদানি বাড়ানোর প্রয়োজন থাকলেও সেটি সামনে আসছে না। যে কারণে বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। যার প্রভাবে বেড়ে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতিও। এ ছাড়া রপ্তানি আয় বেশি হচ্ছে খাতাপত্রে দেখানো হলেও, এর ইতিবাচক প্রভাব রিজার্ভে পড়ছে না। অপরদিকে রাজস্ব আয়ের প্রকৃত তথ্য না থাকায় সরকারি ব্যয়ে অব্যবস্থাপনা হচ্ছে। এটি মোকাবিলায় সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি অঙ্কের ঋণ করতে গিয়ে চাপের মুখে ফেলছে অর্থনীতিকে। ফলে তথ্যের গরমিল থাকায় এসব খাতে বিদ্যমান নীতিগুলো প্রকৃতপক্ষে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেটি আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
চাল, ডাল, মাছসহ খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত ১২০-১৩০টি পণ্যের দামের ওঠা-নামার পরিবর্তন নিয়ে মূল্যস্ফীতি নির্ণয় করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিবিএসের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন বাজারে পণ্যের দাম সঠিকভাবে সংগ্রহ না করলে গরমিল হবে মূল্যস্ফীতির হার নির্ণয়ে। তবে বিবিএসের পণ্যের মূল্য কম দেখানোর প্রবণতা থাকে বলে রিপোর্টে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির চিত্র আসে না।
এদিকে সরকারের প্রকাশিত জিডিপির হারের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পূর্বাভাসের মধ্যে প্রায় প্রতি বছরই অমিল থাকে। সাধারণত সরকারের লক্ষ্যমাত্রা সব সময় বেশি দেখা গেছে। চলতি অর্থবছরের জিডিপির হার নির্ধারণ করে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ধরা হলেও বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে ৪ শতাংশ হবে বলে প্রকাশ পেয়েছে। আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হলেও শেষ পর্যন্ত অর্জন হয় ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। কিন্তু উন্নয়ন সহযোগীরা জিডিপি প্রবৃদ্ধির এ হারকে স্বীকার করছে না। তারা প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কম দেখাচ্ছে। সেখানে বিশ্বব্যাংক বলছে অর্জন হবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক ঢাকার সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরিসংখ্যান নিয়ে গরমিলের বিষয়টা অনেকদিন ধরেই আলোচনায় ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এটার প্রতিবাদ তেমন কেউ করেনি। আবার ব্যক্তিগতভাবে যারা প্রশ্ন তুলেছিলেন তাদের কথা শোনেনি তৎকালীন সরকার। সরকার বাহবা নিতে এসব করেছে। এতে করে যে সমস্যাটা হয়েছে তা হলো, জিডিপি বেশি দেখানো হলেও প্রকৃতক্ষে মানুষের জীবনমানের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। আবার উৎপাদন ও চাহিদার সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ না করায় বাজারে এর একটা বড় রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে তিনি মনে করেন।