এলাকায় পরিচিত জমিদার বংশের সন্তান হিসেবে। সম্পদের উৎস নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে তিনি এই পরিচয় দিতেন। টানা ১৬ বছর জমিদার পরিচয়ে সম্পদ নিয়ে গেছেন অন্য চূড়ায়। জড়িয়েছেন মাদক কারবারেও। রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী ছিলেন সবসময়ই আলোচনায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধ সম্পদ আয়ের সিন্ডিকেট ছিল ফারুকের। সিন্ডিকেট সদস্যদের মাধ্যমে করতেন নিয়োগবাণিজ্য। কোথাও নিজেই ডিল করতেন। শিক্ষক নিয়োগে অন্তত ২০০ কোটি টাকা কামিয়েছেন। গোদাগাড়ীর শীর্ষ হেরোইন ব্যবসায়ীদের তিনি নিজে নার্সিং করতেন। তাদের কাছ থেকে নিয়েছেন দামি গাড়িসহ উপঢৌকন। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে তাকে মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক উল্লেখ করা হয়। দলীয় কর্মসূচি পালনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের করেছেন জিম্মি। নিয়েছেন মোটা অঙ্কের চাঁদা। দলীয় পদবাণিজ্য করে কামিয়েছেন অঢেল টাকা। সূত্রে জানা গেছে, ফারুক চৌধুরী ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তার হয়ে টাকা আদায়ের জন্য দলীয় নেতাদের ব্যবহার করতেন। প্রথম দিকে গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি বদিউজ্জামান বদি, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ, তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি গোলাম রাব্বানী ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুনকে কাজে লাগিয়েছেন। তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে গত ১০ বছর এ দায়িত্বে ছিলেন গোদাগাড়ী এবং তানোরের সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, লুৎফর হায়দার রশিদ ময়না ও আবুল বাসার সুজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থিম ওমর প্লাজার এক কর্মচারী জানান, থিম ওমর প্লাজায় ফারুক চৌধুরীর রাজনৈতিক কার্যালয় আছে। রাত ১১টার পর তিনি সেখান থেকে নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দিতেন। এরপর শুরু হতো মাদকব্যবসায়ীদের আনাগোনা। বেশি যাতায়াত ছিল গোদাগাড়ীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আবদুর রহিম টিপু, তার আপন বড়ভাই গোদাগাড়ী পৌরসভার কাউন্সিলর মনিরুল ইসলাম মনি, মাদক ও হুন্ডি ব্যবসায়ী আসাদুল, জসিম, মাটিকাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহেল রানা। অর্ধশতাধিক মাদকব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিনি প্রতি মাসে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা নিতেন। মাসে ৪ কোটি হিসেবে ১৬ বছরে তিনি মাদকব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সাড়ে সাত শ কোটি টাকা নিয়েছেন।
ফারুক চৌধুরী তার মালিকানাধীন থিম ওমর প্লাজায় গোদাগাড়ী এবং তানোরের অর্ধশতাধিক মাদকব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকে দোকান ও ফ্ল্যাট নিতে বাধ্য করেন। প্রত্যেকটি দোকানের জন্য নিয়েছেন ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। ফ্ল্যাটের জন্য কোটি টাকা। এভাবে তিনি ৮০টি দোকান এবং ফ্ল্যাট উচ্চ দামে বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন অর্ধশত কোটি টাকা। ফারুক চৌধুরীর নির্বাচনি এলাকায় বছরে টিআর ও কাবিখা প্রকল্পে বরাদ্দ আসত তিনবার। এ বাবদ বরাদ্দ ছিল ৬ কোটি টাকা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ-মাদরাসাসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে এ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে বরাদ্দের ৮০ ভাগই নিয়েছেন তিনি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির দুই উপজেলায় আসত প্রতি বছর ৪ কোটি টাকা। এ বরাদ্দও ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে ৮০ ভাগ টাকা হাতিয়ে নিতেন ফারুক। চরআষাড়িয়াদহের সড়ক সংস্কারের পাঁচটি প্রকল্পের পুরো ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। ১৬ বছরে এ তিন খাত থেকে প্রায় ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। গোদাগাড়ী সদরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামানের প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি নিজের নামে লিখে নিয়েছেন ফারুক চৌধুরী। গোদাগাড়ী এবং তানোরের অর্ধশতাধিক হাট ও ঘাট নিয়ন্ত্রণ করতেন ফারুক চৌধুরীর সহযোগী আবুল বাশার সুজন। অন্যদের সরিয়ে দিয়ে এগুলো স্বল্পমূল্যে নিলাম নিয়ে ফারুক তার শাসনামলে শত কোটি টাকা কামিয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ফারুক চৌধুরী ও তার ঘনিষ্ঠরা আত্মগোপনে আছেন। থিম ওমর প্লাজার ম্যানেজার পরিচয়ে একজন বলেন, ‘স্যারের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। দেশের বাইরে থেকে স্যারের মেয়ে ব্যবসার খোঁজখবর নেন।