মাত্র ১৬-১৭ বছর আগের কথা। যশোর-৪ আসনের সাবেক এমপি রণজিৎ রায়ের পিতা নগেন্দ্র নাথ রায় যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার খাজুরা বাজারে পানের ব্যবসা করতেন। পরে লবণের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এই বাজারেই তাদের পারিবারিক টিনের বাড়ি। ২০০৮ সালের আগেও এলাকার মানুষ রণজিৎ রায়কে দেখলে উল্টোপথে হাঁটতেন। কারও সঙ্গে দেখা হলেই বাজার করার কথা বলে টাকা ধার চাইতেন তিনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর যশোর-৪ আসনের হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্বস্তরের মানুষ ঘরে থাকা মুরগির ডিম, মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে দিয়েছিলেন রণজিৎ রায়ের হাতে। হলফনামাতেও তার পুরো নির্বাচনি খরচের টাকা বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনরা দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ওই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী টিএস আইউবের বিরুদ্ধে ৫ হাজার ৩০০ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন তিনি। এলাকার মানুষের মুখে মুখে খুবই প্রচলিত একটি গল্প। শপথ নেওয়ার জন্য টাকা বাঁচাতে সাধারণ পরিবহনে ঢাকায় গিয়েছিলেন রণজিৎ। পথে জ্যামে পড়ে শপথ অনুষ্ঠান ধরতে ব্যর্থ হন। ফলে দ্বিতীয় দফায় তাকে শপথ নিতে হয়। শপথ নেওয়ার পর দ্রুত বদলে যেতে থাকেন রণজিৎ রায়। আগের রণজিতের সঙ্গে পরের রণজিৎকে মেলাতে পারেন না এলাকার মানুষ, এমনকি দলের নেতা-কর্মীরাও। এমপি পদকে জমি দখল আর টাকা বানানোর মেশিনে পরিণত করেন তিনি। পর পর তিন দফা এমপি থাকাকালে শ্মশানের জমি থেকে শুরু করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমিও লিখে নিয়েছেন নিজের নামে। সরকারি প্রকল্পে লুটপাট, চাঁদাবাজি, ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, স্কুল-কলেজে নিয়োগ ও কমিশন বাণিজ্য করে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে ও বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা সল্টলেকসহ বিভিন্ন স্থানেও তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে বলে রণজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান।
শ্মশানের জমি দখল : দীর্ঘদিন ধরে বাঘারপাড়া উপজেলার ধান্যকুড়া মৌজায় চিত্রা নদীর পাড়ে সরকারি জমিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মৃতদেহ সৎকার করা হতো। কিন্তু নদী খননের সময় এ শ্মশান ঘাট বিলীন হয়ে যায়। স্থানীয় শ্মশান নির্মাণের জন্য পরে ২০২০ সালে আশপাশের সাত গ্রামের হিন্দুরা চাঁদা তুলে ৭৭ শতক জমি ক্রয় করেন ১৭ লাখ ৭১ হাজার টাকায়। শ্মশানের নামে রেজিস্ট্রি হলে এই জমি ডিসির মাধ্যমে সরকারের কাছে চলে যাবে। নিজেদের টাকায় কেনা জমি সরকারকে দেওয়া যাবে না। এ কথা বলে রণজিৎ রায় সে সময় শ্মশানের জন্য কেনা ৭৭ শতক জমি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেন। ধান্যখোলা গ্রামের পুরোহিত জয়দেব ব্যানার্জি বলেন, সাত গ্রামের হিন্দুদের টাকায় কেনা জমি রণজিৎ রায়ের নামে রেজিস্ট্রি করায় ওই সময় কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু আমলে নেওয়া হয়নি। তেলিধান্য গ্রামের গোবিন্দ বিশ্বাস বলেন, সবাই ক্ষুব্ধ ছিলেন, কিন্তু অনেকেই প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। আমরা চাই, শ্মশানের জমি শ্মশানের নামেই হোক। বাঘারপাড়ার মথুরাপুরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালে তিন শতক জমি দেন মোহাম্মদ আবদুল্লাহ নামের এক যুবক। শর্ত ছিল তাকে ওই প্রকল্পে চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু রণজিৎ রায় ওই জমি নিজের নামে লিখে নেন। ৬ কোটি টাকার ওই প্রকল্পটি ব্যাপক লুটপাট হওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদও সেটি বুঝে নেয়নি। আবদুল্লাহর এখন জমিও নেই, চাকরিও নেই। বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তখনকার যুগ্ম সম্পাদক (বর্তমানে সাধারণ সম্পাদক) হাসান আলীকে পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন এনে দেওয়ার কথা বলে পাঁচ বিঘা জমি রণজিৎ রায় তার এক অনুসারীর নামে লিখে নেন। এ ব্যাপারে হাসান আলী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ করলে একপর্যায়ে চাপে পড়ে সেই জমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন রণজিৎ রায়। হাসান আলী বলেন, দল ক্ষমতায় থাকতে রণজিৎ রায়ের অপকর্ম নিয়ে অনেক কথা বলেছি। দলের দুর্দিনে তাকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
পৈতৃক টিনের বাড়ি থেকে এখন একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট : ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বাঘারপাড়ার খাজুরা বাজারে পৈতৃক টিনের বাড়িতেই বসবাস করতেন রণজিৎ রায়। নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী তার সর্বসাকুল্যে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল। এগুলো হলো পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ১ লাখ টাকা মূল্যের ৪ বিঘা জমি, খাজুরায় চার শতক জমির ওপর ৫০ হাজার টাকা মূল্যের টিনের ঘর। এ ছাড়া তার বার্ষিক আয় দেখানো হয় ১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। আর তার স্ত্রী নিয়তি রানির ছিল নগদ ৭০ হাজার টাকা ও ১৫ হাজার টাকা মূল্যের ৫ তোলা স্বর্ণ। তবে তার আয়ের কোনো উৎস ছিল না।
তিন দফা এমপি থাকার পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় রণজিৎ কুমার রায় দাবি করেন, তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৫ কোটি টাকারও বেশি। আর স্ত্রী নিয়তি রানির স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি টাকার বেশি। যশোর শহরের রেল রোডে রণজিৎ রায় ও তার স্ত্রী নিয়তি রানির দুটি বাড়ি রয়েছে, যার একটি চারতলা ভবন। এই চারতলা বাড়িতে বসবাস করতেন রণজিৎ। এই বাড়ির কয়েক শ গজ দূরে তিনতলা একটি ভবনের মালিক তার স্ত্রী নিয়তি রানি। এ দুটি বাড়িতেই বর্তমানে ভাড়াটিয়ারা রয়েছেন। একজন ভাড়াটিয়া জানান, ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের দিনও রণজিৎ রায় পরিবার নিয়ে চারতলা বাড়িতে ছিলেন। ওইদিন বিকালের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
এ ছাড়া বাঘারপাড়া উপজেলা শহরে দোতলা ও খাজুরা বাজারে তিনতলা বাড়ি রয়েছে রণজিৎ রায়ের। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ যশোর উপবিভাগের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, যশোর শহরের উপশহর এলাকায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের আবাসন প্রকল্পে সাড়ে ১২ শ স্কয়ার ফুটের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে সাবেক এমপি রণজিৎ কুমার রায়ের।
স্কুল-কলেজে নিয়োগ ও কমিশন বাণিজ্য : বাঘারপাড়া ও অভয়নগর উপজেলা এবং যশোর সদর উপজেলা বসুন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে যশোর-৪ সংসদীয় আসন। অভিযোগ রয়েছে, বিশাল এই এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একচেটিয়া নিয়োগবাণিজ্য করেছেন রণজিৎ রায় ও তার পরিবারের সদস্যরা। রণজিৎ রায়, তার স্ত্রী নিয়তি রানি, দুই ছেলে রাজীব রায় ও সজীব রায় অন্তত ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বেসরকারি স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ নিয়োগে ১০ থেকে ২২ লাখ টাকা, কর্মচারী নিয়োগে ৫ থেকে ৮ লাখ টাকা নির্ধারণ করে দেন তিনি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী, স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্য সহকারী ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের নিয়োগ নিয়েও তার বিরুদ্ধে বাণিজ্য করার অভিযোগ আছে। দুই উপজেলায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত ও কলেজ সরকারিকরণের নামেও কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, টেন্ডার বাণিজ্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কমিশন নিতেন তিনি। তার পক্ষে টেন্ডার ও প্রকল্পের কমিশন-বাণিজ্য তদারকি করতেন তার ছেলে বাঘারপাড়া উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রাজীব রায়, নওয়াপাড়া পৌরসভার মেয়র সুশান্ত কুমার দাস ও শ্রমিক নেতা রবিন অধিকারী।