আটপৌরে শাড়িতে সাদামাটা চালচলন। খুলনায় এলে বাড়িতে ভিড় লেগে থাকত। বেলা করে ঘুম থেকে উঠতেন। সব অনুষ্ঠানেই হাজির হতেন দেরিতে। ঘন ঘন পান খেতেন- দিতেন লম্বা বক্তৃতা।
চারপাশে সাদামাটা ভালো মানুষের এমন চেহারাই ফুটিয়ে তুলতেন। কিন্তু এসবের পেছনে ছিল দুর্নীতি, অর্থ পাচার, নিয়োগ পদোন্নতিতে অর্থবাণিজ্য আর লুটপাটের কালো অধ্যায়। বারবার সমালোচিত হলেও সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান লুটপাটেও পরিবারতন্দ্রের চর্চা করেছেন। খুলনা-৩ আসন থেকে ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সালে নির্বাচনে সংসদ সদস্য ও দুই দফায় প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় তার মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ও খুলনায় তার সংসদীয় আসনে সব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেন মন্নুজান সুফিয়ান। অনুসন্ধানে দেখা যায়, শ্রম প্রতিমন্ত্রী দায়িত্বে থাকাকালীন স্বজনদের নিয়ে তিনি অনিয়মের সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। মন্নুজান সুফিয়ান, তার ভাই ও এপিএস মো. সাহাবুদ্দিন, সাহাবুদ্দিনের মেয়ে শামীমা সুলতানা, বোনের ছেলে ইয়াছির আরাফাতের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য মিলেছে। নিয়োগ, পোস্টিং, পদোন্নতিতে সিন্ডিকেট চক্রটি কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছে। মন্নুজানের নিজ নামেই ঢাকার উত্তরায় ১০ নম্বর সেক্টরে রাজউকের ৫ কাঠা জমি, খুলনার দৌলতপুরের সাহেববাড়ি রোডে তিন তলা বাড়ি, দুটি গাড়ি, কেডিএ ময়ুরী আবাসিকে ১৬ দশমিক ৭ কাঠা জমি রয়েছে। শামীমা সুলতানাকে গার্মেন্ট মালিকদের কেন্দ্রীয় তহবিলের সহকারী পরিচালক, তার স্বামী মুহাম্মদ মেহরাব পাটোয়ারী, ভাগ্নে ইয়াসির আরাফাত কেন্দ্রীয় তহবিলের নীতিনির্ধারক পদে চাকরি দেওয়া হয়। চক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন খুলনা বিভাগীয় শ্রম দপ্তর থেকে সদ্য বদলিকৃত শ্রম পরিচালক মিজানুর রহমানের শ্যালক কে এম আবদুল্লাহ হাবীব। ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মিজানুরকে উপ-পরিচালক পদ থেকে মন্নুজানের সুপারিশে পরিচালক করা হয়। চক্রের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
নিয়োগ-পদোন্নতিতে অর্থবাণিজ্য : ২০১৪ থেকে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি নিয়োগে মন্নুজান সুফিয়ান আধিপত্য বিস্তার করেছেন। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি অর্থের বিনিময়ে ডিও লেটার দিতেন। তার বোনের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস দোলা কুয়েটের সেকশন অফিসার পদে চাকরি করেন। তার সুপারিশে চাকরি পাওয়া ডেপুটি রেজিস্ট্রার দোলন কুমার মিস্ত্রি ও সহকারী পরিচালক মনোজ কুমার মজুমদার কুয়েটে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেন। এখানেও সিন্ডিকেট বানিয়ে তার নিয়ন্ত্রণেই চালানো হতো কুয়েট প্রশাসনকে। কুয়েটের ঠিকাদারি কাজেও মন্নুজান সুফিয়ানের হস্তক্ষেপ ছিল। মন্ত্রণালয়ের অধীনে দপ্তরগুলোতে নিয়োগে ঘটেছে ব্যাপক অনিয়ম। পদোন্নতিতে মানা হয়নি কোনো নীতিমালা। মেধাতালিকা বাদ দিয়ে পছন্দেও লোকজনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমানকে পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির সুপারিশের বাইরে ছিলেন মিজানুর। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মেধাতালিকা ও শ্রম অধিদপ্তরের গ্রেডেশন তালিকা অনুযায়ী তার অবস্থান ছিল ১৫তম। মন্নুজানের সুপারিশে মিজানকে গ্রেডেশন তালিকার বাইরে থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
২০২২ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত শ্রম সম্মেলনে মন্নুজানের সফরসঙ্গী হন তার মেয়ে, জামাতা ও চাচাতো ভাই। সরকারি সফরে নিজের আত্মীয়-স্বজন থাকায় এ সময় তিনি ব্যাপক সমালোচিত হন।
মন্নুজানের বিরুদ্ধে মামলা, জমি দখলের অভিযোগ : ২৭ সেপ্টেম্বর খুলনায় মন্নুজান সুফিয়ানসহ ৪৩ জনের বিরুদ্ধে খুলনার আড়ংঘাটা থানায় বিএনপি অফিস ভাঙচুরের অভিযোগে মামলা হয়। আড়ংঘাটা ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ মিশ্র বাদী হয়ে আড়ংঘাটা থানায় এ মামলা দায়ের করেন। চলতি বছরের ৪ আগস্ট বিএনপির অফিস ভাঙচুর করা হয়। মামলায় মন্নুজানের ভাই সাহাবুদ্দিনকেও আসামি করা হয়।
একইভাবে ২১ আগস্ট খুলনায় বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগে মন্নুজান সুফিয়ানের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়। নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি অফিস ভাঙচুরের অভিযোগে মো. ইলিয়াস শেখ নামের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে খালিশপুর থানায় মামলাটি দায়ের করেন। এ ছাড়া মন্নুজান সুফিয়ানের বিরুদ্ধে খুলনা-যশোর মহাসড়কের মীরেরডাঙ্গায় ইটভাটার জমি দখলের অভিযোগ করেন খানজাহান আলী থানা এলাকার বাসিন্দা ভুক্তভোগী হারুন অর রশিদের পরিবার। ২৪ আগস্ট দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে তারা দাবি করেন- মাহবুব ব্রাদার্স নামে এক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে জমি দখলের সহযোগিতা করেছেন মন্নুজান সুফিয়ান। সর্বশেষ সংসদে মন্নুজান সুফিয়ান সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ৫ আগস্টের পর মন্নুজান সুফিয়ান, তার ভাই সাহাবুদ্দিনসহ ঘনিষ্ঠজন অনেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন।