অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা কারণে রড ও সিমেন্ট উৎপাদনে ধস নেমেছে। যত দিন যাচ্ছে এই দুই খাতের অবস্থা তত করুণ হচ্ছে। উদ্যোক্তারা পুঁজি হারানোর আশঙ্কায়। ইতোমধ্যে বেশকিছু ছোট কারখানা বন্ধ হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের বছরের তুলনায় গত সেপ্টেম্বরে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে রড ও সিমেন্টের চাহিদা। বাজারে সিমেন্টের চাহিদা কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ; অপরদিকে রডের চাহিদা কমেছে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদনকারীরা এখন দাম কমিয়ে বাজার ধরে রাখতে চাইছেন। তাতেও কাজ হচ্ছে না। চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে শুধু যে উৎপাদন কমে গেছে তা-ই নয়, রড ও সিমেন্টশিল্পের উদ্যোক্তাদের অনেকের পুঁজিও কমেছে। বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং ও স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এস কে মাসুদুল আলম মাসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা ব্যাংকগুলোকে টাকায় এলসি পরিশোধ করলেও কাঁচামাল আমদানি করতে হয় ডলারে। এখন ডলারের দাম ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় উঠেছে। ফলে রড ও সিমেন্টশিল্পের যে পুঁজি ছিল তার প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে শুধু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা মহামারির পর থেকে ডলারের দাম বৃদ্ধি, উচ্চ সুদ হার এবং মূল্যস্ফীতির কারণে পুঁজির ঘাটতিসহ রড ও সিমেন্টশিল্প মালিকরা নানা বাধার মুখে পড়েন। উপরন্তু এলসি মার্জিন বৃদ্ধি, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত, কাঁচামালের ঘাটতি, গ্যাস ও বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান দাম বৃদ্ধির কারণে এমনিতেই এ শিল্পের উদ্যোক্তারা চাপে ছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে নির্মাণশিল্পে স্থবিরতা নেমে আসে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দুই মাস পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতির বদল হয়নি।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আলমগীর কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনৈতিভাবে দেশে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে বেসরকারি খাত খুব বেশি প্রয়োজন না পড়লে এখন নির্মাণকাজ করছে না। যারা শুরু করেছিলেন নানা অনিশ্চয়তার কারণে তারাও কাজ বন্ধ রেখেছেন। অপরদিকে মেগাপ্রকল্পসহ বেশির ভাগ সরকারি কাজ বন্ধ রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদারদের অনেকে পালিয়ে যাওয়ায় মফস্বল ও গ্রামীণ এলাকায় নির্মাণকাজও বন্ধ রয়েছে। এর ফলে সিমেন্টের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমেছে। তাদের হিসাবে সিমেন্টশিল্পে প্রায় ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত চাহিদা কমেছে বলে জানান অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। রড ও সিমেন্ট উৎপাদনে জড়িত সূত্রগুলো বলছে, জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিন মাসে রড ও সিমেন্টের বাজার এত খারাপ যাচ্ছে যে, বেশির ভাগ কোম্পানি পণ্যের দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছে। শুধু তাই নয়, চাহিদা না থাকায় উৎপাদন কমাতেও বাধ্য হচ্ছে কারখানাগুলো। ইস্পাত নির্মাতারা অপারেটিং খরচ মেটাতে গত মাসে প্রায় টনপ্রতি ৬ হাজার টাকা থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত দাম কমিয়েছেন।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ৬০ গ্রেডের মাইল্ড স্টিল (এমএস) রড বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৯৩ হাজার টাকায়, যা মাত্র এক মাস আগে টনপ্রতি ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা ছিল।
অটো রি-রোলিং ও স্টিল মিল মালিকরা বলছেন, স্থানীয় ইস্পাত চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবহার হয় সরকারি প্রকল্প ও নির্মাণকাজে। দেশের মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি সরকারি নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় এ শিল্পের চাহিদায় ধস নেমেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, কর্মীদের বেতন ও ইউটিলিটি বিল মেটানোর জন্য মিলাররা এখন উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে স্টিল বিক্রি করছেন। মিলগুলো তাদের তৈরি করা প্রতি টন স্টিলে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় অনেকে চুল্লিগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এস কে মাসুদুল আলম মাসুদ বলেন, করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দুই বছর ধরে নির্মাণশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ছিল। সরকার কৃচ্ছ্রনীতি গ্রহণ করায় অনেক কাজ বন্ধ হয়। ব্যাংকগুলোও টাকা দিতে পারেনি। এখন নতুন সরকার আসায় যেসব জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদার ছিলেন বেশির ভাগই পলাতক। ফলে পুরনো কাজগুলো একেবারেই বন্ধ রয়েছে। আবার নতুন সরকার এসে কোনো কাজও শুরু করেনি। এতে রডের চাহিদা একেবারে কমেছে।
অটো রি-রোলিং ও স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের এই প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আরও বলেন, শুধু যে রডের চাহিদা কমেছে তা-ই নয়, অনেক ব্যাংক থেকে জমা টাকা তুলতে পারছেন না। সামগ্রিকভাবে নির্মাণকাজে স্থবিরতা বিরাজ করায় রডের পাশাপাশি সিমেন্টসহ সব ধরনের নির্মাণ উপকরণের চাহিদা কমেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি অচল হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।