নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বছরের মধ্যেই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেন। এবার জুলাই-আগস্ট গণহত্যার অভিযোগে এ ট্রাইব্যুনালেই বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে শেখ হাসিনা, তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও তাঁর সরকারের অনুসারীদের বিরুদ্ধে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে শুরু হয়েছে নতুন অধ্যায়। গতকাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিই ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম আদেশ। দ্বিতীয় আদেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। পৃথক দুই আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এসব আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আদেশে পরোয়ানাভুক্তদের গ্রেপ্তার করে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে হাজির করতে বলা হয়েছে। এর আগে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম তাঁদের গ্রেপ্তারের আবেদন করেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদ, মো. সাইমুম রেজা তালুকদার সঙ্গে ছিলেন।
শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের ছাড়াও পরোয়ানা জারি হওয়াদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, দীপু মনি, আ ক ম মোজাম্মেল হক, জুনাইদ আহমেদ পলক, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, সাবেক সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ, পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার, প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক র্যাব ডিজি হারুন অর রশিদ, সাবেক এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর প্রথমবারের মতো গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ শুরু হয়। এদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কোর্টের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর মামলার আবেদন পড়ে শোনান। এ সময় সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে গুম, খুন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান, অর্থ পাচারের পরিসংখ্যান এবং সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনে বলপ্রয়োগের তথ্য তুলে ধরেন তিনি। চিফ প্রসিকিউটর আদালতে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্তে গণহত্যার প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আসামিরা প্রভাবশালী। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে আসামিদের লোকজন বিভিন্ন পজিশনে আছেন। তাই আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া মামলার তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করছি। এক পর্যায়ে আদালত জানতে চান, রাষ্ট্রীয়ভাবে আসামিদের অবস্থান জানেন কি না। জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, না। তারপর আদালত চিফ প্রসিকিউটরের আবেদন মঞ্জুর করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। আর ১৮ নভেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ রেখে এ সময়ের মধ্যে আসামিদের আদালতে হাজির করতে বলেন।
পরে ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলাম। আদালত আমাদের আবেদন মঞ্জুর করেছেন। একটি আবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আরেকটি আবেদনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ১৮ নভেম্বরের মধ্যে তাঁদের গ্রেপ্তার করে এ আদালতে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ১৮ নভেম্বর পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হলেই ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির করতে হবে। যাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, সাংবাদিকরা তাঁদের নাম জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এ অপরাধীদের অনেকে এখনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। সে কারণে তাঁদের সবার নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। আমরা নিরাপত্তা ও কৌশলগত কারণে এসব নাম প্রকাশ করছি না।
এর আগে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহতদের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করা হয়। গণহত্যার অভিযোগে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ১৪-দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা, পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র্যাবের তৎকালীন ডিজি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। প্রায় সব অভিযোগেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঘটনার তারিখ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে গণহত্যার অভিযোগগুলোয়। এ ছাড়া এ সময়ে আহত হয়ে পরে বিভিন্ন তারিখে নিহতরাও এর আওতায় থাকবেন। ঘটনার স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশকে। অপরাধের ধরনে বলা হয়েছে, প্রধান আসামির নির্দেশ ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে তাদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেন।
স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটি একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন একটি ট্রাইব্যুনালে চলছে বিচারকাজ।
৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের কিছুদিন পরই ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান অবসরে যান। আর এক সদস্যকে হাই কোর্টে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। অন্য সদস্য অব্যাহতি নেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রসিকিউটররা পদত্যাগ করেন। পরে ৫ সেপ্টেম্বর চিফ প্রসিকিউটরসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর নিয়োগ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সলিসিটর অনুবিভাগ।
১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর ১৫ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে যোগ দেন তিন সদস্যের বিচারক প্যানেল। গত মঙ্গলবার তাঁদের এজলাসে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আর প্রথমবারের মতো গতকাল বিচার কার্যক্রম শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল।