শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

লিভারে চর্বি সমস্যা

ডা. বিমল চন্দ্র শীল এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন) এমডি (গ্যাস্ট্রো), মেম্বার-আইএসজি (ইন্ডিয়া), মেডিসিন, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক, গ্যাস্ট্রো এন্টেরোলজি বিভাগ স্যার সলিমুল­ক্ষাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা। চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।

লিভারে চর্বি সমস্যা

ডা. বিমল চন্দ্র শীল

ব্যাধিবোধ

লিভারে চর্বি বা ফ্যাটি লিভার : সাম্প্রতিককালে ফ্যাটি লিভার নামক একটি রোগের প্রাদুর্ভাব প্রায়ই লক্ষণীয়। লিভার বা যকৃতের কোষসমূহে অতিরিক্ত চর্বি জমার কারণেই ওই রোগ দেখা দেয়।

প্রকারভেদ : ১। অ্যালকোহলিক (মদ্যপানজনিত) ফ্যাটি লিভার রোগ ২। নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার রোগ (মদ্যপানজনিত নয় এমন কারণে ফ্যাটি লিভার রোগ)। যেহেতু এই রোগটিই আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়, এই প্রবন্ধে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার রোগটি আলোকপাত করা হলো।

লিভারে চর্বি জমার কারণ : শরীরের অতিরিক্ত ওজন, রক্তে চর্বির আধিক্য, ডায়াবেটিস, ইনসুলিন কার্যকরহীনতা ইত্যাদি। কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়ামবিহীন আরামপ্রদ জীবনযাপন এবং অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস উপরোক্ত অবস্থাসমূহের প্রধান কারণ।

লিভারে চর্বির অন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণসমূহ : মদ্যপান, হেপাটাইটিস সি, উইল্সন ডিজিজ, অনেক দিন ধরে উপবাস, হরমোনজনিত রোগ- হাইপোথাইরয়েডিজম, হাইপোপিটুইটারিজম, কিছু ওষুধ যেমন- এমিয়োডেরন, স্টেরয়েড, মেথোট্রেক্সেট, টেমোক্সিফেন, ভেলপ্রোয়েট ইত্যাদি।

বিভিন্ন গবেষণাপত্রে রোগটির ব্যাপকতা দেখানো হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, স্থ‚ল দেহ (বি এম আই > ৩০)- ৯৪% লোক রোগাক্রান্ত, অতিরিক্ত ওজন (বি এম আই > ২৫)- ৬৭% লোক রোগাক্রান্ত, স্বাভাবিক ওজন- ২৫% লোক রোগাক্রান্ত,  ডায়াবেটিস রোগী- ৪০-৭০% লোক রোগাক্রান্ত। (বি এম আই) =   শরীরের ওজন (কেজি)/উচ্চতা (মিটার) ২। আমাদের দেশে সাধারণ হিসাবে শতকরা ১৮ থেকে ২০ ভাগ মানুষ ওই রোগে ভুগছেন।

 

 

রোগটি কীভাবে অগ্রসর হয়?

লিভারে চর্বি (Steatosis) > কোষসমূহে চর্বিজনিত প্রদাহ (Steatoepatitis) > ক্রমবর্ধমান লিভারে ফাইব্রোসিস > লিভার সিরোসিস > লিভার ক্যান্সার।

ফ্যাটি লিভার রোগের জটিলতায় ক্ষয়ক্ষতি : লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সার, হৃদরোগজনিত ঝুঁকি বৃদ্ধি।

রোগটির লক্ষণগুলো কী কী?

ক) বেশির ভাগ রোগীই লক্ষণহীন থাকেন এবং সাধারণত ঘটনাক্রমে রোগটি নির্ণীত হয়। লিভার ফাংশন টেস্টে অস্বাভাবিকতা বা লিভার সাইজ বড় হওয়া বা অন্য রোগের জন্য পরীক্ষা করার সময়ে বিশেষত আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে রোগটি ধরা পড়ে।

খ) কারও কারও পেটের ডান দিকে উপরি অংশে একটু ভার ভার বা হালকা ব্যথা অনুভূত হতে পারে। কেউ বা শারীরিক দুর্বলতার অভিযোগ করে থাকেন।

গ) কখনো কখনো রোগী ফ্যাটি লিভার রোগের জটিলতা নিয়ে আসতে পারেন (যেমন লিভার সিরোসিস ও তার জটিলতাসমূহ, লিভার ক্যান্সার ইত্যাদি।)

ফ্যাটি লিভার রোগীর কী কী পরীক্ষা করা প্রয়োজন?

১। রক্ত পরীক্ষা : কোনো নির্দিষ্ট একটি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি নির্ণয় করা যায় না। কিছু লিভার এনজাইম যেমন- ALT, AST, ALP, GGT মাত্রা বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে ALT এনজাইম, AST এর তুলনায় বাড়তি থাকবে, যা অ্যালকোহলিক লিভার রোগের বিপরীত। সন্নিহিত কিছু রক্ত পরীক্ষা যেমন Viral Marker- HBsAg, Anti HCV, রক্তে চর্বির মাত্রা, রক্তে গ্লুকোজ মাত্রা, থাইরয়েড হরমোন ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া উচিত।

২। আলট্রাসনোগ্রাফি : এটি ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।

৩। সিটিস্ক্যান : ওই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমেও ফ্যাটি লিভার নির্ণয় করা যায়।

৪। ফাইব্রোস্ক্যান লিভার : ওই পরীক্ষার মাধ্যমে লিভারের নমনীয়তা দেখা হয় এবং লিভার কোষের চর্বি জমার আপাত পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। ওই পরীক্ষা দ্বারা রোগটির ক্রমঅগ্রসরমানতা চেক করা যায়।

৫। লিভার বায়োপসি : এ পরীক্ষাটি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড, যার মাধ্যমে লিভার কোষসমূহে চর্বি, চর্বিজনিত প্রদাহ ও ফাইব্রোসিস ব্যাপ্তি দেখা যায়। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে পরীক্ষাটির প্রয়োজন হয়।

চিকিৎসা : ফ্যাটি লিভার রোগের চিকিৎসায় দুটি দিক থাকে যেমন- ১. লিভার রোগের চিকিৎসা ২. রোগটির সন্নিহিত অবস্থানগুলো নির্ণয় ও চিকিৎসা, যেমন- শরীরের স্থ‚লতা, চর্বির আধিক্য, ডায়াবেটিস ইনসুলিন অকার্যকর, কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকিসমূহ ইত্যাদি।

কী করণীয়?

> বর্তমানে ফ্যাটি লিভারের জন্য দরকার শরীরের ওজন কমানো, দৈনন্দিন ব্যায়াম। তাই কম ক্যালরিযুক্ত আঁশসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন।

> শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। শরীরের ৫-১০% ওজন কমালে লিভারের চর্বি ও চর্বিজনিত প্রদাহ যথেষ্ট পরিমাণে কমে এবং লিভারের এনজাইমগুলো স্বাভাবিক হয়। তবে মনে রাখতে হবে অতি দ্রুত শরীরের ওজন কমানো ঠিক নয়।

> সুষম কম ক্যালরিযুক্ত আঁশসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। যেমন- সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, ইত্যাদি। উচ্চ শর্করা বা চর্বিসমৃদ্ধ খাবার যেমন- ঘি, মাখন, পনির, লাল মাংস, মাছের ডিম, বড় মাছের মাথা বর্জনীয়। এতে শরীরের পরিপাক সঠিক হয় এবং ওজন ঠিক রাখতে সহায়তা করে।

> সর্বতোভাবে নেশাজাতীয় দ্রব্য বর্জন করতে হবে। মদ্যপান ত্যাগ করুন।

> ফাস্টফুড, কার্বোনেটেড চর্বি বা শর্করা সমৃদ্ধ ড্রিংকস, চকোলেট বর্জনীয়।

> দৈনিক শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম শরীরের ওজন ও লিভারের চর্বি কমায়। তাই রোজ ঘণ্টাখানেক ঘাম ঝরিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করুন।

> ডায়াবেটিস অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় কী ওষুধ ব্যবহার করা হয়?

বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো ওষুধই জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তনের চেয়ে অর্থাৎ দৈনন্দিন ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের বেশি কার্যকর নয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ওষুধ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে ব্যবহার করা হয় যেমন- ভিটামিন-ই, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ইত্যাদি। রক্তে চর্বির আধিক্য কমাতে স্টাটিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

ফ্যাটি লিভারে রোগ হলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। খুব কম সংখ্যক রোগীরই জটিলতা তৈরি হয় এবং ভালো হতে অনেক সময় লাগতে পারে। তাই ভালো থাকার জন্য শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখুন। দৈনন্দিন ব্যায়ামের অভ্যাস করুন, রোগমুক্তি আসবেই আসবে।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর