শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অনুপ্রেরণীয় একজন

রণক ইকরাম

অনুপ্রেরণীয় একজন

তাসমিমা হোসেন। ২৭ বছর ধরে সম্পাদনা করছেন দেশের সবচেয়ে প্রচলিত নারীবিষয়ক পত্রিকা পাক্ষিক ‘অনন্যা’। এখন কেবল অনন্যা নয়, দায়িত্ব নিয়েছেন দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত  সম্পাদকের। তাসমিমা হোসেন এ দেশের নারী সাংবাদিক কিংবা উদ্যোক্তা তো বটেই সামগ্রিক অর্থেই অনুপ্রেরণীয় একজন। তার সঙ্গে নিবিড় আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার জীবনযাত্রা ও ভাবনার নানাদিক। জানাচ্ছেন- রণক ইকরাম

 

তিনি একাধারে একজন সফল উদ্যোক্তা এবং সম্পাদক। ২৭ বছর ধরে সম্পাদনা করছেন দেশের সবচেয়ে প্রচলিত নারীবিষয়ক পত্রিকা পাক্ষিক ‘অনন্যা’। এখন কেবল অনন্যা নয়, দায়িত্ব নিয়েছেন দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের। তাসমিমা হোসেন এ দেশের নারী সাংবাদিক কিংবা উদ্যোক্তা তো বটেই সামগ্রিক অর্থেই অনুপ্রেরণীয় একজন। কন্যা-জায়া-জননী হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে পার করেছেন জীবনের মুহূর্তগুলো। এখনো তারুণ্যদীপ্ত ভাবনার দোল মনের উঠোনজুড়ে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে নিবিড় আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার জীবনযাত্রা ও ভাবনার নানাদিক। জানাচ্ছেন- রণক ইকরাম

ছোটবেলায় দারুণ ডানপিটে ছিলেন তাসমিমা হোসেন। মুন্সীগঞ্জের ছায়া সুনিবিড় শীতল পরিবেশে কেটেছে তার শৈশবের দিনগুলো। কিন্তু কী হতে চেয়েছিলেন তিনি? প্রশ্ন করতেই মৃদু হাসলেন। জানালেন, ‘অনেক বড় কিছু হতে চেয়েছিলাম।’ তার সেই ইচ্ছেটা কতটুকু পূরণ হয়েছে সেটা অবশ্য তিনি বলেননি। তবে শৈশবটা বেশ বর্ণিল ছিল তার। তার ভাষায়, ‘পঞ্চাশ দশকের কথা বলছি। আমাদের সময় কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। এখনকার মতো গাড়িতে করে স্কুলে নিয়ে যাওয়া কিংবা স্কুল থেকে নিয়ে আসার মতো কোনো বিষয় ছিল না। মুক্ত বিহঙ্গের মতো ছিলাম। সারা দিন ঘুরে বেড়াতাম। কখনো পাইলট হয়ে উড়তে চেয়েছি, হা-ডু-ডু খেলেছি, মার্বেল খেলেছি, গুলতি খেলেছি। আবৃত্তি করতাম, প্রচুর ঘুরে বেড়াতাম। বিশাল বড় স্কুলের আঙিনায় খেলতাম। ভোরে সবাই মিলে মসজিদে যেতাম। সেই দিনগুলো আসলেই অন্যরকম ছিল।’

অন্যরকম দিন পেরিয়ে তাসমিমা হোসেন পৌঁছে গেছেন অন্যরকম উচ্চতায়। সংসদ সদস্যের দায়িত্ব যেমন পালন করেছেন, তেমনি সম্পাদক প্রকাশক হিসেবে ২৭ বছর ধরে দাঁড় টানছেন নারীদের পত্রিকা পাক্ষিক অনন্যার। নারী অধিকার, সচেতনতা আর সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের সূত্রগুলো সমাজের আপামর নারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন বছরের পর বছর ধরে। শুরুটা কিন্তু সহজ ছিল না। অনন্যা শুরু করতে গিয়ে যেমন প্রতিক‚লতার সম্মুখীন হয়েছিলেন তেমনি নিয়মিত চালাতে গিয়েও কষ্ট হয়েছে অনেক। কিন্তু তিনি পিছু হটেননি। অদম্য ইচ্ছে আর ভালোবাসার সম্মিলনে কাজ করে যাচ্ছেন। নিজের কর্মজীবনের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘বিয়ের পর পারিবারিকভাবে সংবাদপত্রের বলয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। এর আগে থেকেই এনজিওর কাগজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। মঞ্জু যখন ইত্তেফাকে যেত, তখন কাছ থেকে সব দেখেছি। এর মধ্যেই আমার ভাবনা আসে নারীদের নিয়ে একটি পত্রিকা করার। কিন্তু ইত্তেফাকের বাইরে থেকে ম্যাগাজিন করা সহজ ছিল না। আমার ফুপাতো বোন লায়লা সামাদের অনন্যা নামে একটা পত্রিকা ছিল। নামটি আমার খুব পছন্দ হলো। এরপর তার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে এক সময় অনন্যা শুরু করি। পরের গল্পটা সবার জানা।’

 

ইত্তেফাক, অনন্যা এবং দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতার গল্পও কিন্তু কম রোমাঞ্চকর নয়। তিনিই বললেন, ‘নিজের চোখে সব পরিবর্তন দেখেছি। এখনকার নারী আর তখনকার নারীদের চাহিদায় পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে কন্টেন্টেও। এখন যেমন লাইফস্টাইল রিলেটেড কন্টেন্টে পত্রিকা ভরা থাকে। এর কারণ একটাই বাণিজ্য। সবকিছুতেই কমার্শিয়াল চিন্তা ঢুকে পড়েছে। এ কথাটি অনন্যা ইত্তেফাক দুই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে ইত্তেফাকের কাজ ও অনন্যার কাজের মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি পাক্ষিক, অন্যটি দৈনিক। তবে আমি উপভোগ করছি। কারণ শুরু থেকেই আমি নিজেকে সম্পাদক তো বটেই একজন ভালো ব্যবস্থাপক হিসেবেও দেখতে চেয়েছি।’

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সহধর্মিণী। নিজের ব্যস্ততার কারণে অবসর খুব একটা পান না। এরপরও যতটা পান টিভি দেখে আর বই পড়ে সময় কাটে। চেষ্টা করেন প্রতিদিন কম করে হলেও ১০ পৃষ্ঠা বই পড়ার। নাতিদের সঙ্গে গল্প করেও সময় কাটান। রান্না-বান্নাটা খুব ভালো পারেন। ১৯৭৭-এ একবার পর্যটনে সেরা রন্ধনবিদের পুরস্কারও জিতেছেন। তবে রান্না করার এখন খুব একটা সময় পান না। তার প্রিয় খাবার সরষে বাটা আর ইলিশ মাছ। তবে সেটা অবশ্যই নিজের হাতে তৈরি হবে। এর বাইরে গরম ভাতের সঙ্গে ঘি-ও তার দারুণ পছন্দ।

তাসমিমা হোসেন চেষ্টা করেন সময়ের সঙ্গে সব সময় গুছিয়ে থাকতে। তবে নিজেকে কোনো মতেই ফ্যাশনেবল মানতে রাজি নন তিনি। তার কাছে ফ্যাশনের সংজ্ঞাটাও অবশ্য ভিন্ন। ‘আসলে আমার কাছে সময়ের সঙ্গে মিল রেখে পরিবর্তনটা গ্রহণ করা। তাই বলে অপর্ণা সেন কিংবা বিদ্যা বালান কিন্তু আমার কাছে ফ্যাশনেবল নন। তারা গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রির অংশ। আমি যেমন কখনো হাতকাটা ব্লাউজ পরি না। রুচিসম্মত পরিবর্তনটা গ্রহণ করার চেষ্টা করি। তাই আমার কাছে ফ্যাশনটা একেবারেই ভিন্ন। তবে আমি চেষ্টা করি গুছিয়ে থাকার জন্য।’

দারুণ স্পষ্টবাদী এই মানুষটি সময়ানুবর্তীও বটে। সোজাসাপ্টা জীবনে অভ্যস্ত। দারুণ সাজানো ধানমন্ডির বাড়িটার পরতে পরতে রুচির ছাপ। বাড়ির ঠিক সামনেই ফুলের বাগানের দিকে তাকালেই মন ভরে যাবে। আপাদমস্তক স্বপ্নচারী তাসমিমা হোসেন বিশ্বাস করেন একদিন সত্যি সমস্ত বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাবে দেশের নারীরা।

ছবি : শিশির জাহাঙ্গীর

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর