চৈত্রের শেষ ভাগ, বৈশাখের শুরু। রোদ যেন নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরছে। গরমে চারদিক অস্থির। সেই সঙ্গে রয়েছে আর্দ্রতা। জনজীবনে নেমে আসছে নানা বিপর্যয়। বাড়ছে গরমের স্বাস্থ্য সমস্যা, রোগ-জরা। সচেতন না হলেই নয়...

যারা শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি এবং যারা বাইরে কাজ করেন ও প্রয়োজনমতো পানি পান করার সুযোগ পান না, তারাই মারাত্মক পানিস্বল্পতায় বেশি আক্রান্ত হন। এ ক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং কিডনির সমস্যাও হতে পারে। পানিস্বল্পতা ছাড়াও গরমের কারণে ত্বকে ঘামাচি ও অ্যালার্জি হতে পারে। গরমে অতিরিক্ত ঘাম তৈরি হয়, ফলে ঘর্মগ্রন্থি ও নালি ফেটে যায়। ত্বকের নিচে ঘাম জমতে থাকে। এটাই ঘামাচি। অনেক সময় ঘাম ও ময়লা জমে ঘর্মনালির মুখ বন্ধ হয়ে যায় এবং সেখানে ইনফেকশন হতে পারে। এতে ঘামাচি ও অ্যালার্জি বেড়ে যায় এবং ঘামে গন্ধ হতে পারে। ঘাম ও ময়লার কারণে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগও এ সময় বেশি হয়। গরমে যারা সূর্যের আলোর নিচে সরাসরি বেশিক্ষণ থাকেন, তাদের ত্বক পুড়ে যেতে পারে। এতে ত্বক লাল হয়ে যায়, জ্বালাপোড়া করে, চুলকায় ও ফোসকা পড়ে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিই মূলত এর জন্য দায়ী। যারা ফর্সা বা ত্বক নাজুক, তাদের এই সমস্যা বেশি হয়। গরমে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হলো হিটস্ট্রোক। হিটস্ট্রোকের আগে হিট ক্র্যাম্প হয়, ফলে শরীর ব্যথা করে, দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা লাগে। পরবর্তী সময়ে হিট এগজোসশন দেখা দেয়, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, মাথাব্যথা করে এবং রোগী অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেওয়া না হলে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফা. ছাড়িয়ে যায়। একে হিটস্ট্রোক বলে। এর লক্ষণ হলো—তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফা. ছাড়িয়ে যায়, ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং ত্বক শুষ্ক ও লাল হয়ে যায়, নিঃশ্বাস দ্রুত হয়, নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়, রক্তচাপ কমে যায়, খিঁচুনি হয়, মাথা ঝিমঝিম করে এবং রোগী অসংলগ্ন ব্যবহার করতে থাকে। রোগীর প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, অজ্ঞান হয়ে যায়, এমনকি শকেও চলে যেতে পারে। গরমে অন্য আনুষঙ্গিক সমস্যা হতে পারে।

অনেকেই গরমে তৃষ্ণা মেটাতে ঘরের বাইরের পানি বা শরবত খান, যা অনেক সময় বিশুদ্ধ নয়। এ কারণে ডায়রিয়া ও বমিতে আক্রান্ত হতে পারেন। একই কারণে পানিবাহিত অন্যান্য রোগ, যেমন—টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ইত্যাদি বেশি হয়। গরমে অনেকে প্রচুর পানি পান করেন, কিন্তু তাতে পর্যাপ্ত লবণ থাকে না। ফলে লবণের অভাব দেখা দেয়। গরমে অনেক সময় খাবার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ওই খাবার খেলে বদহজমসহ দেহে পেটের পীড়া হতে পারে। গরমের এসব সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য যা করতে হবে—

♦ যথাসম্ভব ঘরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকার চেষ্টা করুন।

♦ বাইরে বেরোলে রোদ এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজনে টুপি বা ছাতা ব্যবহার করতে পারেন। হালকা, ঢিলেঢালা ও সুতির কাপড় পরুন। শরীর যতটা সম্ভব ঢেকে রাখার চেষ্টা করুন।

♦ শরীরের উন্মুক্ত স্থানে সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন, যা রোদে পোড়া থেকে ত্বককে সুরক্ষা দেবে।

♦ প্রচুর পানি ও তরল পান করতে হবে। ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুই-ই বের হয়ে যায়, এজন্য লবণযুক্ত পানীয়, যেমন— খাওয়ার স্যালাইন, ফলের রস ইত্যাদি পান করতে হবে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত।

♦ নিয়মিত গোসল করুন এবং শরীর ঘাম ও ময়লামুক্ত রাখতে হবে।

♦ শ্রমসাধ্য কাজ যথাসম্ভব কম করতে হবে। কাজের মাঝে কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নিতে হবে। প্রচুর পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে।

♦ গুরুপাক খাবার এড়িয়ে চলুন। সাধারণ খাবার, যেমন— ভাত, ডাল, সবজি, মাছ ইত্যাদি খাওয়া ভালো। খাবার যেন টাটকা হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। নানারকম ফল, যেমন— আম, তরমুজ ইত্যাদি এবং লেবুর শরবত শরীরের প্রয়োজনীয় পানি ও লবণের ঘাটতি মেটাবে।

♦ শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা নিন। শিশু স্কুলে কিংবা মাঠে খেলাধুলা করতে গেলে যেখানে সেখানে পানি বা শরবত যেন না পান করে, বিশুদ্ধ পানি ও পানীয় যেন গ্রহণ করে তা নিশ্চিত করতে হবে। বয়স্ক ব্যক্তিরা দীর্ঘক্ষণ রোদে চলাফেরা এড়িয়ে চলুন।

♦ প্রচণ্ড গরমে কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। রোগীকে দ্রুত শীতল কোনো স্থানে নিয়ে যেতে হবে। ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিতে হবে, সম্ভব না হলে পাখা দিয়ে বাতাস করতে হবে। রোগীর গরম কাপড় খুলে দিতে হবে এবং ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। সম্ভব হলে গোসল করাতে হবে। রোগীকে প্রচুর পানি ও খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।