এবার অনেকটা আগেই বর্ষা শুরু হয়েছে। গ্রীষ্ম ঋতুকে পেছনে ফেলে বৈশাখের শেষভাগেই সারা দেশে বর্ষা বিছিয়েছে বৃষ্টির জাল। এর সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। প্রতি বর্ষাতেই কমবেশি ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। তবে, আধুনিকায়নের এই যুগেও অনেকেই মনে করেন যে ডেঙ্গু জ্বর খুব মারাত্মক রোগ এবং মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। এই ধারণা ভুল। সঠিকভাবে চিকিৎসার মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত প্রায় শতভাগ রোগীই ভালো হয়ে যায়।
ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত পাঁচ থেকে ছয় দিন থাকে এবং তারপর জ্বর সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। তবে কখনো কখনো দুই বা তিন দিন পর আবার জ্বর আসতে পারে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু জ্বরে মারাত্মক সমস্যা হওয়ার সময় এটাই। এ সময় প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায় এবং রক্তক্ষরণসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। জ্বর কমে যাওয়ার পরবর্তী কিছুদিনকে তাই বলা হয় ঝুঁকিপূর্ণ সময়। এ সময়টাতে সবারই সচেতন থাকা জরুরি।
জ্বরের শুরুতে বা দু-এক দিনের জ্বরে রক্ত পরীক্ষায় কোনো কিছু শনাক্ত না-ও হতে পারে। মনে রাখতে হবে প্লাটিলেট কাউন্ট চার বা পাঁচ দিন পর থেকে কমতে শুরু করে, তাই জ্বর শুরুর পাঁচ বা ছয় দিন পর রক্ত পরীক্ষা করা উচিত।
অনেকেই দিনে দু-তিনবার করে প্লাটিলেট কাউন্ট করে থাকেন। প্লাটিলেট কাউন্ট ঘন ঘন করার প্রয়োজন নেই, দিনে একবার করাই যথেষ্ট, এমনকি মারাত্মক ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারেও। তা ছাড়া, একই সঙ্গে একাধিক ল্যাবরেটরি থেকে প্লাটিলেট কাউন্ট না করানোই ভালো, এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। দেখা যায়, বিভিন্ন ল্যাবরেটরি থেকে বিভিন্ন রকমের রিপোর্ট আসছে; এতে কোন রিপোর্ট সঠিক তা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। চিকিত্সক বা রোগী বিভ্রান্তিতে পড়েন।
ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাসের কারণে হয়, সেহেতু উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়। যেমন জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ এবং এর সঙ্গে প্রচুর পানি ও শরবত জাতীয় তরল খাওয়ানোই যথেষ্ট। খেতে না পারলে বা অন্য কোনো প্রয়োজনে শিরাপথে স্যালাইন বা গ্লুকোজ ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় রোগী ও চিকিত্সক উভয়েই রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। যদি রক্তক্ষরণ না হয় এবং রোগীর রক্তের হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক থাকে তাহলে রক্ত পরিসঞ্চালন করার প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে রক্ত দিলে লাভ তো হবেই না বরং অন্য কমপ্লিকেশন এমনকি হার্ট ফেইলরও হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, রক্তের প্লাটিলেট কম হলেই অনেকে রক্ত দিয়ে বসে। এতে লাভ হবে না। মনে রাখতে হবে শুধু কম প্লাটিলেট কাউন্টের জন্য রক্ত দেওয়া উচিত নয়।
এ ছাড়া প্লাটিলেট রিচড প্লাজমা (পিআরপি), প্লাজমা, ডেক্সট্রান ইত্যাদি কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই দেওয়া যাবে, যেমন ডেঙ্গু শক সিনড্রোম, ডিআইসি। অযথা এগুলো না দেওয়াই ভালো। শিরাপথে এলবুমিন দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
ডেঙ্গু চিকিৎসায় করণীয়
♦ ডেঙ্গু কোনো মারাত্মক রোগ নয় এবং এতে চিন্তার কিছু নেই। রোগী ও রোগীর লোকদের অভয় দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
♦ ডেঙ্গু জ্বর নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়, এমনকি কোনো চিকিৎসা না করলেও। তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিত্সকের পরামর্শ নিয়েই চলতে হবে, যাতে কোনো মারাত্মক জটিলতা না হয়।
♦ ডেঙ্গু রোগে কি কি করা দরকার, তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ; কি কি করা যাবে না, তা জানাও গুরুত্বপূর্ণ। যা যা করা যায় তা প্রয়োজন অনুযায়ী করতে হবে, অতিরিক্ত করা যাবে না।
♦ রক্ত বা প্লাটিলেট পরিসঞ্চালন অপরিহার্য এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
ডেঙ্গু মশা ও তার বংশবৃদ্ধির পরিবেশ দুটিই আমাদের চারপাশে বিদ্যমান। তাই ডেঙ্গু ঠেকিয়ে রাখা কঠিন। ডেঙ্গু আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই ডেঙ্গু জ্বরকে ভয় না পেয়ে এর সঙ্গে যুদ্ধ করেই এবং একই সঙ্গে প্রতিরোধ করেই চলতে হবে।